জামাই ষষ্ঠী পূজা পদ্ধতি: বাংলা সংস্কৃতির এক চিরন্তন ঐতিহ্য — যেখানে শাশুড়ি মায়ের স্নেহ, আদর আর আশীর্বাদে ভরে ওঠে জামাইয়ের দিন! জামাই ষষ্ঠী শুধুই একটি পূজা নয়, এটি শাশুড়ি-জামাইয়ের সম্পর্কের এক মধুর বন্ধন, শুভ কামনা আর পারিবারিক মিলনের এক বিশেষ আয়োজন। এই পূজার নিয়ম-কানুন, আচার-অনুষ্ঠান এবং বিশ্বাসের ভিতরেই লুকিয়ে আছে যুগ যুগের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ।”

জামাই ষষ্ঠী পূজা পদ্ধতির পূর্ণ বিধি
সময় বা কাল—প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এই ব্রত করার নিয়ম। সধবা বিবাহিতা কন্যার জননী (মায়েরাই) এই ব্রত নিতে ও পালন করতে পারে। সকালের দিকে (অনেকে দুপুরেও করেন)।
জামাই ষষ্ঠী পূজার উপকরণসমূহ:
ব্রতের দ্রব্য ও বিধান—
- ষষ্ঠীদেবীর ছবি/প্রতিমা (না থাকলে অংকিত প্রতীক)
- পাটার আসন বা নতুন কাপড়
- ধান, দূর্বা,প্রদীপ, ধূপ, চন্দন, সিঁদুর,তেল
- কাঁচা হলুদ ও সিঁদুর মাখানো সুতো
- মঙ্গলঘট
- হলুদে ছোপন কাপড়ের টুকরো,
- নতুন ৬ গাছা সুতো
- ৬টি পান
- ৬টি সুপুরি, বাঁশপাতা
- ফল (বিশেষত আম, কাঁঠাল, কলা, জাম, লিচু)
- মিষ্টি (মোয়া, সন্দেশ, খাজা)
- দই, মূড়ি, চিঁড়ে, খই
- পূর্ণপাত্র (জলে ভরা কলস, উপরে আমপাতা ও নারকেল)
- পূর্ণফল (মিষ্টি, পান, সুপারি, ধান, দূর্বা, সিঁদুরসহ)
অরণ্যষষ্ঠী-ব্রত বা জামাই ষষ্ঠী পূজা পদ্ধতি
জ্যৈষ্ঠে মাসি সিতে পক্ষে ষষ্ঠী চারণ্যসংজ্ঞিতা।
ব্যজনৈককরাস্ততামটভি বিপিনে স্ত্রিয়ঃ ॥
তাং বিন্ধ্যবাসিনীং স্কন্দষষ্ঠীমারাধয়ত্তি চ।
কন্দমূলফলাহারা লিভস্তে সস্তুতিং ওভাম্ ॥ রাজমার্ত্তণ্ডে ।
জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিকে অরণ্যষষ্ঠী বলা হয়। এই ষষ্ঠীতে স্ত্রীলোকেরা তালপাতার পাখা ও পূজার অন্যান্য সামগ্রী লইয়া বনভূমিতে গমন করে অরণ্যষষ্ঠী দেবীর পূজা করিয়া। পূজা শেষে ব্রতের কথা পাঠ ও শ্রবণ করেন এবং ওই দিন ফল-মূলাদি আহার করে ব্রত পালন করেন। বিশ্বাস করা হয়, এই ব্রত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলে সন্তান সন্ততির দীর্ঘায়ু ও ঐশ্বর্য্যশালী হয়।
জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে এই ব্রত করতে হয়। পূজার স্থানে ষষ্ঠীদেবীর ছবি বা প্রতীক পিটুলি দিয়ে একটি কালো বেড়াল এঁকে একটা পিটুলির কঙ্কণ করে পাশে মঙ্গলঘট স্থাপন করুন।এরপর ফল-মূলে বাটা সাজিয়ে দেবেন। তারপর ৬টা পান ও ৬টা সুপুরি হলুদে ছোপানো কাপড়ের টুকরো বাঁশ পাতায় জড়িয়ে, ৬ গাছা সুতো পাকিয়ে ও হলুদ মাখিয়ে তার সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। এই সুতোকে ষাট সুতো বলা হয়। চিঁড়ে, খই, দই, তেল ও হলুদ দিয়ে মা ষষ্ঠীর পুজো করবেন।
পূজাবিধি। —স্বস্তিবাচনানত্তর ‘সূর্য্যঃ সোমো’ মন্ত্র পাঠ করিয়া সঙ্কল্প করিবে। যথা— বিষ্ণুন’ মোহদ্য জ্যৈষ্ঠে মাসি শুক্লে পক্ষে · ষষ্ঠ্যান্তিথৌ অমুকগোত্রা শ্রীঅমুকী দেবী (বা দাসী) শুভলগুড়ি- গপপত্যাদি নানাদেবতা পূজাপূর্ব্বক-বিশ্ববাসিনাং প্রাপ্তিকামা স্কন্দষষ্ঠীং পুঞ্জরিষ্যে।
অতঃপর আসনশুদ্ধি ও ভূতগুদ্ধি প্রভৃতি করিয়া, গণেশাদি দেবতাগণের পূজা করতঃ অঙ্গন্যাস ও করন্যাস করিয়া স্কন্দষষ্ঠীর ধ্যান করিয়া পূজা করিবে ।
জামাই ষষ্ঠী পূজায় স্কন্দষষ্ঠী-ধ্যান।—
ওঁ দ্বিভুজাং যুবতীং ষষ্ঠীং বরাভয়যুতা স্মরেৎ।
গৌরবর্ণাং মহাদেবীং নানালঙ্কারভূষিতাম্ ॥
দিব্য- বস্ত্রপরীধানাং বাম ক্রাড়ে সুপুত্রিকাম্ ।
প্রসন্ন-বদনাং নিত্যং জগদ্ধাত্রীং সুখপ্রদাম্ ॥
সৰ্ব্বলক্ষণসম্পন্নাং পীনোন্নতপয়ো- ধরাম্।
এবং ধ্যায়েৎ স্কন্দষষ্ঠীং সর্ব্বদা বিন্ধ্যবাসিনীম্ ॥
অতঃপর যথাবিধি পূজা সমাপন করিয়া প্রণাম করিবে ।
জামাই ষষ্ঠী পূজায় প্রণাম মন্ত্র—
জয় দেবি জগম্মাতজ গদানন্দকারিণি ।
প্রসীদ মম কল্যাণি নমস্তে ষষ্ঠী-দেবতে ॥
অতপর অরণ্য ষষ্ঠীর ব্রতে কথা পাঠ বা শ্রবণ করিবে।
জামাই ষষ্ঠীতে জামাতার পূজা (পুত্ররূপে):
জামাইষষ্ঠীর দিনে আপনি সর্বপ্রথম জামাতাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাবেন। এরপরে নতুন পোশাক—যেমন পাঞ্জাবি ও ধুতি, কিংবা যদি জামাই আধুনিক পোশাক পছন্দ করে, তাহলে শার্ট-প্যান্ট— উপহার দেবেন । জামাতা আসার পূর্বে খুব যত্ন করে ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে আসন বিছিয়ে রাখবেন। জামাতা সেই পোশাক পরিধান করে আসনে, তবে সমাদর ও স্নেহের সঙ্গে আসনে বসতে অনুরোধ করুন।
আসনে বসার পরে আসনের সম্মুখে বাম পাশে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবেন এবং একটি কাঁসার থালায় ধান, দূর্বা, সিঁদুর, পান-সুপারি, ও শঙ্খ সাজিয়ে রাখবেন। পাশাপাশি আরেকটি কাঁসার থালায় নানা রকম ফল ও মিষ্টান্ন,মোয়া বা সন্দেশ পূর্ণ করে সাজিয়ে এই থালার অর্ঘ্য জামাইকে অর্পণ করবে। তারপর জামাইয়ের ডান হাতে ষাট সুতো বেঁধে দেবেন এবং কপালে চন্দনের ফোঁটা দেবে। এরপর মাথায় ধান আর দূর্বা ছড়িয়ে তাকে আশীর্বাদ করবে। আর নিচে দেওয়া সুন্দর মন্ত্রটি জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় উচ্চারন করবেন।
মন্ত্র পাঠের পর জামাতাকে বরণ ডালা দিয়ে বরণ করে শঙ্খ বাজাবেন। বরণ করা হয়ে গালে জামাই কে পুত্রস্নেহে কাঁসার থালায় সাজিয়ে রাখা ফল, মিষ্টান্ন খাইয়ে দেবেন। সবশেষে, তালপাতার পাখা দিয়ে জামাইকে বাতাস করবেন। এটি কেবল স্নেহের প্রকাশমাত্র নয়, বরং আপনার আন্তরিক যত্ন ও অতিথির প্রতি শ্রদ্ধাসূচক সেবার প্রতীক।
জামাই ষষ্ঠীতে জামাইকে আশীর্বাদ মন্ত্র:-
“দীর্ঘায়ু স্ত্বম্ ভব সুস্থঃ, সন্ততি সমন্বিতঃ।
সুখী ভব গৃহে তব, ধন-ধান্য সাম্যযুক্তঃ।
মাতা-পিতৃ ভক্তিশীলঃ, কন্যার সহ ধর্মপথে চালঃ।
ষষ্ঠীদেবী প্রসন্না ত্বয়ি, পূর্ণ কোরু মম মনোরথঃ॥”
বাংলা অনুবাদ:-
“তুমি দীর্ঘায়ু হও, সুস্থ থেকো, সন্তান-সন্ততিতে পরিপূর্ণ হও।
তোমার গৃহে সুখ ও শান্তি বিরাজ করুক, ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্যে ভরপুর থাকো।
তুমি যেন শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি ভক্তিশীল হও, আমার কন্যার সঙ্গে ধর্মের পথে একসাথে চলো।
ষষ্ঠীদেবী তোমার প্রতি সদয় হোন,আমার মনোকামনা পূর্ণ হোক।”
ইচ্ছা করলে আপনি নিজ পরিবার ও আঞ্চলিক সংস্কার অনুসারে এ মন্ত্রের সঙ্গে অতিরিক্ত শুভকামনা বা মনের কথা যোগ করতে পারেন যেমন।
জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষষ্ঠী ষাট, ষাট,ষাট,ষাট।
শ্রাবন মাসের লোটন ষষ্ঠী ষাট, ষাট,ষাট,ষাট।
ভদ্র মাসের মন্থন ষষ্ঠী ষাট, ষাট,ষাট,ষাট।
অশ্বিন মাসের দূর্গা ষষ্ঠী ষাট, ষাট,ষাট,ষাট।
অগ্রহায়ন মাসের মূলা ষষ্ঠী ষাট, ষাট,ষাট,ষাট।
পৌষ মাসের পাঠৈ ষষ্ঠী ষাট, ষাট,ষাট,ষাট।
মাঘ মাসের শীতল ষষ্ঠী ষাট, ষাট,ষাট,ষাট।
চৈত্র মাসের অশোক ষষ্ঠী ষাট, ষাট,ষাট,ষাট।
বারো মাসে তেরো ষষ্ঠী ষাট, ষাট,ষাট,ষাট।
বিশেষ টিপস:
- জামাই ষষ্ঠীর দিন কন্যার মঙ্গল কামনাতেও প্রার্থনা করা হয়।
- অনেক বাড়িতে এই দিন জামাতাকে “পঞ্চব্যঞ্জন পোলাও “, মিষ্টি, ফল সহ বিশেষ ভোজে আপ্যায়ন করা হয়।
- জামাতার জন্য নতুন পোশাক (পাঞ্জাবি, ধুতি,) উপহার দেওয়া লোকাচার।
- পুজোর শেষে ব্রতকথা শুনে ব্রতীকে ফল খেয়ে থাকতে হবে।
- শেষে ষষ্ঠীর প্রসাদ ও ফল জামাতা ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করুন।
উপসংহার:
জামাই ষষ্ঠী শুধুমাত্র একটি আড়ম্বরপূর্ণ রীতি নয়—এটি বাঙালি সমাজে পারিবারিক সৌহার্দ্য, বংশধারা ও সম্পর্ককে মধুময় করে তোলার এক অপূর্ব উদ্যোগ। এই দিনে ষষ্ঠীদেবীর কৃপায় জামাতা যেন সত্যিই পুত্রসম হয়ে ওঠেন—এই কামনায় সম্পূর্ণ পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
জামাই ষষ্ঠী ও অরণ্যষষ্ঠী ব্রত সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে এখানে ক্লিক করুন।
*জামাই ষষ্ঠী: একটি সম্পর্কনির্ভর ব্রতের মাধুর্য।
*জামাই ষষ্ঠী ব্রত কথা অরণ্য ষষ্ঠীর ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া এক জীবনের গল্প।