জামাই ষষ্ঠী ব্রত কথা:এই কাহিনি কেবল একটি পৌরাণিক গল্প নয়—এটি শিক্ষা দেয় সত্য, ন্যায় আর আত্মশুদ্ধির পথ। মা ষষ্ঠীর অরণ্য ষষ্ঠী ব্রতের মাহাত্ম্য এই কাহিনির মাধ্যমে উঠে এসেছে, যেখানে একজন মায়ের কান্না, একজন দেবীর করুণা এবং ধর্মীয় ব্রতের গুরুত্ব একসূত্রে গাঁথা।
এই গল্প শুধু পড়ার নয়, হৃদয়ে ধারণ করার মতো। চলুন, জেনে নেওয়া যাক সেই চিরন্তন শিক্ষামূলক কাহিনি—ছোটবউ, কালো বেড়াল আর মা ষষ্ঠীর আর্শীবাদের অসাধারণ কাহিনি।

লোভী ছোটবউ ও মিথ্যা অপবাদ
জামাই ষষ্ঠী ব্রত কথা— এক ব্রাহ্মণীর তিনটি পুত্র এবং তাদের তিনজন স্ত্রী ছিল। এই তিন বধূর মধ্যে কনিষ্ঠ বউটি ছিল খাবারের প্রতি অত্যন্ত লোভী। সে ঘরের খাদ্যদ্রব্য গোপনে নিজের জন্য তুলে নিত এবং এই কাজের দায় দিত বাড়ির একটি পোষা কালো বেড়ালটির ওপর। সেই বেড়ালটি ছিল মা ষষ্ঠীর বাহন, এবং প্রতিদিন সে গিয়ে মা ষষ্ঠীর কাছে ছোট বউয়ের এই চুরির কথা জানাত। কিন্তু ছোট বউ কখনোই নিজের অপরাধ স্বীকার করত না।
অরণ্য ষষ্ঠীর ব্রতের দিন
এইভাবে করে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথি এসে উপস্থিত হল—অরণ্য ষষ্ঠীর ব্রতের দিন। ব্রাহ্মণী ব্রত পালন করবেন, বাড়িতে উৎসবের আমেজ। তিনি নিজের হাতে পায়েস, ক্ষীর, মিষ্টি আর নাড়ু তৈরি করলেন পুজোর জন্য। তারপর ছোটবউকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘বউমা, আমি স্নান করে আসছি—তুমি একটু এখানে বসে নজর রেখো, যেন বেড়ালটা কিছুতে মুখ না দেয়।’
ব্রাহ্মণী স্নানের জন্য চলে গেলে ছোটবউ এত ভালো ভালো খাবার দেখে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারল না। মিষ্টি, দই, ক্ষীর, পায়েস—যা পেরেছে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলল। এরপর সামান্য দই বেড়ালের মুখে মাখিয়ে দিল।
ব্রাহ্মণী ফিরে এসে দেখলেন সব খাবার প্রায় শেষ, যেন কেউ খেয়ে ফেলেছে। তিনি ছোটবউকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও বউমা, এই পুজোর জন্য রাখা মিষ্টিগুলো কে এমনভাবে খেয়ে ফেলল?’
ছোটবউ উত্তর দিল, ‘মা, আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, সেই সময় বেড়ালটা আমার চোখে ধুলো দিয়ে সব খেয়ে ফেলেছে। ওর মুখেই তো সব লেগে আছে, দেখুন না।’ এই কথা বলে ছোটবউ বেড়ালটাকে বেশ ক’টা চড়-থাপ্পড় দিয়ে দিল।
ষষ্ঠী দেবীর অভিশাপ অপঘাতের শুরু
শেষমেশ ব্রাহ্মণী আবার সব কিছু নতুন করে সংগ্রহ করে পুজোর আয়োজন করলেন। এদিকে, বেড়ালটি কেঁদে কেঁদে জঙ্গলের দিকে চলে গেল এবং যেখানে দেবী অরণ্যষষ্ঠী অধিষ্ঠিত, সেখানে পৌঁছে নিজের সমস্ত দুঃখের কথা খুলে বলল। সব শুনে ষষ্ঠী দেবী বললেন, “আমি সব জানি—তুই দুঃখ করিস না—আমি খুব তাড়াতাড়ি ছোটবউকে এর ফল ভোগ করাবো।”
এরপর কয়েক মাস কেটে গেল। একসময় ছোটবউয়ের সন্তান সম্ভাবনার লক্ষণ দেখা দিল এবং দশ মাস দশ দিন পর সে একটি ফুটফুটে, চাঁদের মত সুন্দর ছেলে সন্তানের জন্ম দিল। নাতির মুখ দেখে ব্রাহ্মণীর আনন্দ আর ধরে না; তিনি গরীব-দুঃখীদের ডেকে দানধর্ম করতে লাগলেন। ছোটবউ তার সন্তানকে পাশে নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে রাতে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু দুর্ভাগ্য! সকালে ঘুম ভেঙে দেখে, তার কোলে ছেলে নেই! শাশুড়ী ও বউ—দুজনেই খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। চারিদিকে বহু লোক পাঠিয়ে ছেলেটির খোঁজ করা শুরু হল, কিন্তু কোথাও তার কোনো হদিস পাওয়া গেল না।
ছোটবউয়ের মা ষষ্ঠীর সঙ্গে সাক্ষাৎ পরীক্ষা ও মুক্তি
এইভাবে ছোটবউয়ের পরপর সাতটি ছেলে এবং একটি মেয়ে জন্ম নেয়, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, একটিও টিকে থাকেনি। প্রতিদিন রাতে ছোটবউ তার সন্তানকে নিয়ে শোয়, কিন্তু সকাল হলেই দেখা যায়—সন্তানটি আর নেই। তখন পাড়ার লোকেরা বলতে শুরু করল, ছোটবউ নিশ্চয়ই মানুষ নয়, রাক্ষসী হবে—সে-ই বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলছে। কেউ কেউ বলত, এমন মেয়েকে আর ঘরে রাখা ঠিক হবে না—তাকে এখনই তাড়িয়ে দেওয়া উচিত।
এইসব কথাবার্তা ছোটবউয়ের কানে পৌঁছোতেই, সে আর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। অপমান আর দুঃখ সহ্য করতে না পেরে, একদিন সে নিজেই বাড়ি ছেড়ে বনের দিকে চলে গেল। সেখানে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে বলতে লাগল—‘হে মা ষষ্ঠী, আমার সঙ্গে এমন কেন হলে? তুমি আমাকে সাতটা ছেলে আর একটা মেয়ে দিলে, আবার সব কেড়ে নিলে কেন মা? আমাকেও নিয়ে চলো, আমি আর বাঁচতে চাই না।’
ছোটবউয়ের এই আকুতি শুনে মা অরণ্য ষষ্ঠী করুণা প্রকাশ করলেন। এক বৃদ্ধার রূপে তার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই বনের মধ্যে একা বসে তুমি এত কাঁদছো কেন মা?’ তখন ছোটবউ তার সমস্ত কাহিনি খুলে বলল। সব শুনে মা ষষ্ঠী বললেন, ‘ওরে মেয়ে, তুই তো আসল কথাগুলো গোপন করেছিস! তুইই তো গোপনে মাছ, দুধ আর পুজোর মিষ্টি খেয়ে ফেলতি, আর শাশুড়ির কাছে সব দোষ দিতিস কালো বেড়ালের ওপর। সেই কারণেই তো এই দুর্দশা হয়েছে।’
ছোটবউ বুড়ির পায়ে পড়ে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুমি কে মা? তুমি কেমন করে সব জানলে? আমায় ক্ষমা করো—আমি তোমার পা ছেড়ে উঠব না।’ তখন মা ষষ্ঠী তার কাতরতা দেখে বললেন, ‘আমি মা ষষ্ঠী—এই পৃথিবীতে কে কী করে, সব আমি জানতে পারি।’
ছোটবউ আবার কেঁদে কেঁদে বলল, ‘মা, আমি বড় অন্যায় করেছি, আমার পাপের সীমা নেই। আজ তুমি দয়া করে দেখা দিয়েছো, তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।’ মা ষষ্ঠী তখন বললেন, ‘ওপথের ধারে দেখ, একটা মরা বেড়াল পচে পড়ে আছে। যদি তুমি এক হাঁড়ি দই তার গায়ে ঢেলে দাও, তারপর সেই দই জিভ দিয়ে চেটে চেটে হাঁড়িতে তুলতে পারো—তবেই তোমার সব সন্তানকে ফিরে পাবে।’
সন্তানদের ফিরে পাওয়া ও ব্রতের মাহাত্ম্য
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ছোটবউ এক মুহূর্তও দেরি না করে একটা হাঁড়ি ভরে দই নিয়ে এসে সেই পচা বেড়ালটার গায়ে ঢেলে দিল। তারপর বেড়ালের গা থেকে জিভ দিয়ে চেটে চেটে দইগুলো আবার হাঁড়িতে তুলে আনল এবং তা মা ষষ্ঠীর সামনে হাজির করল। মা ষষ্ঠী ততক্ষণে ছোটবউয়ের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি ছোটবউয়ের হাতে সন্তানদের তুলে দিয়ে বললেন, “এই নাও, তোমার ছেলে-মেয়ে। এই অমৃতসম দই দিয়ে সকলের কপালে ফোঁটা দাও, আর সুখে-শান্তিতে সংসার করো। তবে, আর কখনও পুজোর প্রসাদ চুরি করে খেয়ে আমার বাহনের উপর দোষ দেবে না। সন্তানদের ‘দূর হ, মরে যা’ এমন কথা কখনো মুখে আনবে না। যদি অন্য কাউকে এমন বলতে শোনো, তখন বলবে — মা ষষ্ঠীর দাস ও ষাট ষাট।” এই কথা বলেই মা অরণ্যষষ্ঠী অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ছোটবউ তখন তার সাত ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এল এবং শাশুড়ীর পায়ে প্রণাম করল। এরপর সে ষষ্ঠীদেবীর বলা সমস্ত কথা শাশুড়ীকে খুলে বলল। ব্রাহ্মণী সব কথা শুনে একেবারে বিস্মিত হয়ে গেলেন। নাতি-নাতনীদের ফিরে পেয়ে তিনি অপার আনন্দে ভরে উঠলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নাতি-নাতনীদের বিয়ে দিয়ে দিলেন। পরের বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে ছোটবউ ধুমধাম করে অরণ্যষষ্ঠীর ব্রত পালন করল এবং নিজের মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করে জামাইয়ের কপালে দইয়ের ফোঁটা দিল। সেই সময় থেকেই মা অরণ্যষষ্ঠীর মাহাত্ম্য চারদিকে প্রচারিত হতে লাগল। এই ব্রতকেই পরে ‘জামাইষষ্ঠী’ বা ‘ষষ্ঠী বাটা’ নামে ডাকা হয়।
ব্রতের ফলাফল
এই ব্রত পালন করলে মা তার সন্তানদের রক্ষা করেন এবং পরিবারে কল্যাণ বয়ে আনেন। বিশেষ করে সন্তানদের মায়েরা এই ব্রত করলে তাদের সন্তানের দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল নিশ্চিত হয়।