জামাই ষষ্ঠী: একটি সম্পর্কনির্ভর ব্রতের মাধুর্য

জামাই ষষ্ঠী

জামাই ষষ্ঠী: বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচলিত ব্রত ও পূজাগুলো মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত— আত্ম-জন্য, সমাজ-জন্য এবং সম্বন্ধ-জন্য

  • আত্ম-জন্য ব্রত সেইসব যেগুলি আত্মরক্ষা ও আত্মিক উন্নতির উদ্দেশ্যে পালন করা হয়, যেমন কালীপূজা, শিব চতুদশী ইত্যাদি।
  • সমাজ-জন্য ব্রত সমাজের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত, যেমন দোল, দুর্গোৎসব, নন্দোৎসব।
  • আর সম্বন্ধ-জন্য ব্রত পালন করা হয় পারিবারিক বা আত্মীয় সম্পর্কের মঙ্গল কামনায়। যেমন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, সাবিত্রী চতুর্দশী, বীরাষ্টমী ও জামাই-ষষ্ঠী।

এই শেষোক্তটি— জামাই-ষষ্ঠী— সম্পূর্ণরূপে একটি সম্পর্কনির্ভর ব্রত, যেখানে জামাতাকে পুত্রবৎ ভাবা হয় এবং তার মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠীদেবীর পূজা করা হয়। যেহেতু পুত্রের মতো জামাতা কন্যার মাধ্যমে পরিবারে প্রবেশ করেন, তাই তার কল্যাণ কামনায় এই ব্রতের আয়োজন।

এই দিনে বিবাহিতা কন্যার জননী নিজের জামাতাকে পুত্রের আসনে বসিয়ে, পুত্রস্নেহে স্নাত করে ষষ্ঠী পূজা, মঙ্গলচণ্ডীর পূজা ও কাহিনি পাঠ শেষে পূর্ণফলযুক্ত অর্ঘ্য দিয়ে আশীর্বাদ করেন। সেই আশীর্বাদে থাকে একটাই প্রার্থনা— জামাতা যেন পুত্রতুল্য হন, সন্তানের জনক হন, এবং মাতার মাতৃত্বধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখেন।

পুত্র যেমন পিতার পিতৃত্বের ধারক, কন্যা তেমনি জননীর মাতৃত্বের ধারক। এই দ্বৈততা—পুংত্ব ও স্ত্রীত্ব—একত্রিত হয়েই মানুষত্বের পূর্ণ প্রকাশ ঘটে। জামাই-ষষ্ঠী এই মানুষত্বকে সজীব রাখার এক পরম সাংসারিক সাধনা।

জামাই ষষ্ঠী ব্রতের অন্তর্নিহিত তাত্পর্য

যতদিন না জামাতা বা দৌহিত্র-দৌহিত্রী জীবিত, ততদিন প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠীতে এই পূজা করা কর্তব্য। বিশেষত যে জামাতার বহু সন্তান-সন্ততি আছে, তার পূজাই সর্বাগ্রে হওয়া উচিত, কারণ তিনি সংসার ও বংশধারার ধারক হয়ে উঠেছেন। কিন্তু বাস্তবে এর বিপরীত দৃশ্যই বেশি দেখা যায়।
ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে ও তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় আজকালকার জামাই-ষষ্ঠী হয়ে উঠেছে শুধুই এক নববিবাহিত জামাতার প্রীতিভোজ! যিনি পুত্রপৌত্রাদি লাভ করে সংসারকে সমৃদ্ধ করেছেন, তার প্রতি সমাজে যথার্থ সম্মান বা পূজা নেই। অথচ এই পূর্ণতা-প্রাপ্ত জামাতাই তো মাতার মাতৃত্বকে সার্থক করে তোলেন।

আধুনিকতার অভিঘাতে সম্পর্কের দূরত্ব

বর্তমানে দেখা যায়, নতুন জামাতা হয়তো প্রথম দুই বছর আদরযত্ন পান, তারপর সম্পর্ক শীতল হতে থাকে। শ্বশুর-শাশুড়ি ও জামাতার মাঝে দূরত্ব গড়ে ওঠে। কন্যাদান যেন দায় সেরে ফেলা হয়—”ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ানো”। এভাবে আত্মীয়তার যে আন্তরিক বন্ধন, তা ছিন্ন হয়ে যায়।

এই সম্পর্কগুলিকে যদি সত্যিকারের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতায় গড়ে তোলা যেত, তাহলে পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতি—সবই মধুময় হয়ে উঠত। কিন্তু এখন পারিবারিক আনন্দ-উল্লাসের জায়গায় এসেছে বাণিজ্যিকতা—সব কিছুতেই যেন শুধু লেনদেন।

উপসংহার

জামাই-ষষ্ঠী কোনো বিলাসিতা নয়, কোনো ঠাটবাটের উৎসব নয়—এটি একটি প্রাচীন পারিবারিক ঐতিহ্যের উৎসব, যেখানে বংশানুক্রমের ধারাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সংরক্ষণ করা হয়। আমাদের শাস্ত্রের মূল দর্শনই ছিল এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সংসারকে মধুময় করে তোলা।
আজ সেই মাধুর্য হারিয়ে গেছে, তাই জীবনও হয়ে উঠেছে কঠিন, হাহাকারে ভরা।
আসুন, আবার সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ফিরিয়ে আনি—জামাই-ষষ্ঠীর মতো উৎসবের যথার্থতা ফিরিয়ে দিই।

সনাতন ধর্মের আরও তথ্য জানতে এখানে ক্লিক করুন।

*জামাই ষষ্ঠী ব্রত কথা।

Share Please:
অস্বীকৃতি

এই লেখা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক তথ্য সরবরাহের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। এতে বর্ণিত পুজা পদ্ধতি, মন্ত্র এবং অন্যান্য তথ্য প্রাচীন শাস্ত্র, লোকাচার ও ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে। পাঠকদের অনুরোধ করা হচ্ছে, নিজের বিশ্বাস ও সুবিধা অনুযায়ী পুজা পদ্ধতি গ্রহণ করুন। যেকোনো ধর্মীয় কাজ করার আগে যোগ্য পণ্ডিত বা বিদ্বান থেকে পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই লেখায় দেওয়া তথ্য ব্যবহারের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারকারীর ওপর থাকবে।

Leave a Comment