তুলসী দেবীর জন্ম বৃত্তান্ত পুর্বপুরুষদের বর্ণনা ও দেবী তুলসীর তপস্যার
তুলসী দেবীর জন্ম বৃত্তান্ত ও পুর্বপুরুষদের কাহিনী:- শাস্ত্রমতে তুলসী বৃক্ষ হলেও মূলতঃ তিনি প্রথমে দেবী, তারপর মানবী এবং তারও পরে তিনি বৃক্ষরূপা তুলসী বা তুলসীদেবী। তুলসীদেবীর ইতিহাস জানার জন্য আমরা শাস্ত্র এবং পুরাণের সাহায্য নেবো। তুলসী দেবীর মহিমার কথা বহু শাস্ত্রেই উল্লেখ করা আছে। সেগুলি থেকে যথাসম্ভব এখানে উল্লেখ করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই প্রথমেই আমরা দেবীর মাহাত্ম্য সম্বন্ধে ‘ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ’ থেকে কিছু কথা যেনে নেবো।
ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে দেবী তুলসী জন্ম কাহিনী
‘ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণের’ প্রকৃতিখণ্ডে বর্ণিত আছে —নারায়ণকে নারদ জিজ্ঞাসা করছেন -সাধ্বী তুলসী কিভাবে নারায়ণের স্ত্রী হলেন? পূর্বজন্মে তিনি কোথায় জন্মেছিলেন? এবং তিনি কে? এখনই- বা কোন্ কুলে জন্মগ্রহণ করেছেন? সে তপস্বিনী কার কন্যা? কোন্ তপস্যা বলেই-বা তিনি প্রকৃতি থেকে পৃথক, নির্বিকল্প, নিশ্চেষ্ট, সর্বসাক্ষী পরমব্রহ্ম, পরমাত্মা, ঈশ্বর, সর্বারাধ্য, সর্বজ্ঞ, সর্বেশ, সর্বকারণ, সর্বাধার, সর্বরূপ, সকলের পরিপালক নারায়ণকে পেয়েছেন? কি কারণেই বা তুলসী বৃক্ষরূপে পরিণত হয়েছেন? কিরূপেই-কি কারণেই বা সেই তপস্বিনী অসুরগ্রস্তা হয়েছিলেন তা আমরা জানবো।
তুলসী জন্ম কাহিনী এবং পুর্বপুরুষদের বর্ণনা
তুলসী জন্ম কাহিনী:- এক দেবীর আবির্ভাবের কাহিনীনারায়ণ দেবর্ষি নারদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন— দক্ষ সাবর্ণি নামে এক মনু, বিষ্ণুর অংশে জাত, মহান যশস্বী, কীর্তিশালী, পুণ্যবান ও মহাবৈষ্ণব ছিলেন। তাঁর পুত্রের নাম ছিল ধর্ম সাবর্ণি। তিনিও অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ও বৈষ্ণব ছিলেন। ধর্ম সাবর্ণির ছেলের নাম – বিষ্ণুসাবর্ণি। তিনিও ছিলেন প্রবল বিষ্ণুভক্ত ও জিতেন্দ্রিয়। তাঁর ছেলের নাম – দেবসাবর্ণি । তিনিও পরম বিষ্ণুভক্ত। দেব সাবর্ণির ছেলের নাম রাজ সাবর্ণি ।
রাজ সাবর্ণি পুর্বপুরুষদের মতই অতিশয় বিষ্ণুভক্ত ছিলেন এবং সেই রাজসাবর্ণির পুত্র ছিলেন বৃষধ্বজ। এঁর আশ্রমে স্বয়ং শম্ভু দৈব পরিমিত তিন যুগ অবস্থান করেছেন। সেই বৃষধ্বজ রাজাকে মহাদেব শিব নিজ ছেলের চেয়েও বেশী স্নেহ করতেন।বৃষধ্বজ রাজা লক্ষ্মী সরস্বতী প্রভৃতি কোন দেবতাকেই মানতেন না। তিনি সকল দেবতার পূজাই বন্ধ করে দেন। ভাদ্র মাসে মহালক্ষ্মী পূজা, মাঘ মাসে সরস্বতী পূজাও বন্ধ করে দেন। তিনি যজ্ঞ ও বিষ্ণুপূজা নিজে তো করতেনই না, পরন্তু কেউ করলে তার মহানিন্দা করতেন।
দেবী তুলসীর পুর্বপুরুষদের অভিশাপ বৃত্তান্ত
কোন দেবতাও শিবের ভয়ে সেই রাজাকে শাপ দিতেন না। এক সময় দেব দিবাকর তাঁকে অভিশাপ দেন ‘তুমি শ্রীভ্রষ্ট হও’। নিজের প্রিয় ভক্তকে সূর্যদেব অভিশাপ দেওয়ায় শিবের ভয়ানক রাগ হয়। তিনি রাগে শূল নিয়ে সূর্যের পিছনে পিছনে তাড়া করে ছুটতে লাগলেন। তখন দীনেশ অর্থাৎ সূর্য তাঁর পিতার সঙ্গে ব্রহ্মলোকের শরণাপন্ন হলেন। শিব রাগে ত্রিশূল হাতে নিয়ে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত তাড়া করে গেলেন। তখন নিরুপায় হয়ে ব্রহ্মা সূর্যদেবকে সঙ্গে নিয়ে বৈকুণ্ঠে নারায়ণের শরণাপন্ন হলেন।
কিন্তু শিব ক্ষান্ত না হয়ে, তিনিও তাঁদের পিছু পিছু ত্রিশূল হাতে নিয়ে বৈকুণ্ঠের দিকে যেতে লাগলেন । মহাদেব শিবকে আসতে দেখে ব্রহ্মা, কশ্যপ ও সূর্য ভয়ে কণ্ঠ তালু পর্যন্ত শুকিয়ে গেল। ভয়ে শিবের হাত থেকে বাঁচার জন্য নারায়ণের সারণনাপন্ন হন এবং সর্বেশ্বরকে প্রণাম করে, বার বার তাঁর স্তব করতে লাগলেন এবং শ্রীহরি- চরণে তাঁদের এই ভয়ের কারণ নিবেদন করলেন।
নারায়ণের দ্বারা সূর্য ও ব্রহ্মা কে অভয় প্রদান
তখন নারায়ণ তাঁদের অভয় দিয়ে বললেন হে ভীত মহাত্মাগণ ! তোমরা স্থির হও । আমি থাকতে তোমাদের ভয় কিসের ? যারা যেখানে যেই অবস্থায় ভীতস্ত হয়ে আমাকে স্মরণ করে, আমি তাদের কে সেই সঙ্কট থেকে রক্ষা করি।
হে দেবগণ ! আমিই জগতের পালনকারী ও জগতের কর্তা এবং আমিই ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি করি ও শিবরূপে ধ্বংস করি। আমিই শিব ও আমিই এই ত্রিগুণাত্মক সূর্যস্বরূপ। আমি নানা রূপ ধারণ করে সৃষ্টির পালন করে থাকি। তোমাদের কোন ভয় নেই। তোমরা নিশ্চিন্ত মনে যাও। তোমাদের কল্যাণ হবে। আজ থেকে আমার বরে শঙ্করের থেকে তোমাদের কোন ভয় নেই। সেই ভগবান শঙ্কর সৎ ব্যক্তিদের গতিস্বরূপ ও আশুতোষ। তিনি ভক্তাধীন, ভক্তের ঈশ্বর, মহাত্মা, ভক্তবৎসল। শিব এবং সুদর্শন এরা দু’জনেই আমার প্রিয়। হে ব্রহ্মা, এদের চেয়ে তেজস্বী ব্রহ্মাণ্ডে দ্বিতীয় নেই।
মহাদেব অনায়াসেই কোটি সূর্য, কোটি ব্রহ্মা সৃষ্টি করতে পারেন । তাঁহার কাছে অসাধ্য কিছুই নাই, তিনি নিরন্তর আমার ধ্যানেই ডুবে থাকেন, বলেই বাহ্যজ্ঞানশূন্য। পঞ্চমুখে নিরন্তর তিনি শুধু আমার নাম ও গুণগান করেন। আমিও সেরকমই দিন রাত তাঁর কুশল চিন্তা করি । আমাকে যে – যেভাবে ভজনা করে, আমি সেরূপেই তাদের কৃপা করি। ভগবান মঙ্গলের অধিষ্ঠাতা দেবতা শিব স্বরূপে আমার আরাধনা করে শিব হয়েছেন। এ-জন্য তাঁকে পণ্ডিতেরা মহাদেব শিব বলেন।
মহাদেব শিবের ক্রোধ সম্বরণ বৃত্তান্ত
ভগবান যখন এ-সব কথা বলছেন, সে-সময়ই বৃষারূঢ় রক্ত পদ্মফুলের ন্যায় চক্ষু শঙ্কর সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বৃষ থেকে তাড়াতাড়ি নেমে ভক্তি ও বিনয় সহকারে সেই শান্ত পরাৎপর, সিংহাসনে অবস্থিত রত্ন ও অলঙ্কারে ভূষিত লক্ষ্মীকান্তকে প্রণাম করলেন। যিনি কিরীটী ও কুণ্ডলধারী, চক্রী, বনমালা বিভূষিত, যিনি চতুর্ভুজ, পীত বসনে ভূষিত সেই পরমাত্মা ঈশ্বরকে মহাদেব আগে প্রণাম করে তারপর ব্রহ্মাকে প্রণাম করলেন ৷
সূর্যও এ্যস্তভাবে চন্দ্রশেখরকে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন। তখন কশ্যপ মহাভক্তিভরে শঙ্করকে প্রণাম করে তাঁর স্তব করতে লাগলেন। শিব সর্বেশ্বর বিষ্ণুকে স্তব করে সুখাসনে উপবেশন করলেন। তখন সুখাসনে উপবিষ্ট বিশেষভাবে ক্লান্ত চন্দ্রশেখরকে বিষ্ণুর পারিষদেরা শ্বেত চামর দিয়ে হাওয়া দিতে থাকলেন। শিব সত্ত্বগুণ সংসর্গে ক্রোধশূন্য হয়ে প্রসন্নভাব অবলম্বন করলেন। তিনি পঞ্চমুখে পরাৎপর প্রভু নারায়ণকে স্তব করতে লাগলেন। তখন নারায়ণ অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে সেই দেবসভায় শঙ্করকে অমৃততুল্য, মধুর ও মনোহর বাক্যে বললেন মহাদেব, তুমি সর্বমঙ্গলময়, অতএব তোমাকে মঙ্গল বিষয়ে প্রশ্ন করা উপহাস মাত্র।
নারায়ণ মহাদেব শিবকে ক্রোধের কারণ জিজ্ঞা
তবুও তোমাকে লৌকিক ও বৈদিক বিষয়ে প্রশ্ন করছি। যিনি তপস্যায় ফলদান করেন এবং সকল সম্পদ প্রদানকারী তাঁকে তপস্যা ও সম্পত্তি বিষয়ক প্রশ্ন করাও অযোগ্য। তুমি স্বয়ং জ্ঞানের অধিদেবতা, অতএব তোমাকে জ্ঞানবিষয়ে জিজ্ঞাসাও বৃথা। তুমি নিরন্তর আপদশূন্য, অতএব তোমার মত মৃত্যুঞ্জয়ের “কোন বিপদ নেই তো?” ইত্যাদি রূপে বিপদ বিষয়ে প্রশ্ন করাও অসম্ভব। তুমি আমার আশ্রমে এসেছ, তোমার আসার কথাই বা আর কি জিজ্ঞাসা করব? তবে এরকম ব্যস্তভাবে কেন এসেছ তা অবশ্য জিজ্ঞাসা করা উচিত। অতএব তার কারণই-বা কি তা আমাকে বল ৷
মহাদেব বললেন – ভগবান, রাজা বৃষধ্বজ আমার প্রাণেরও অধিক প্রিয় ভক্ত । তাকে সূর্য শাপ দিয়েছেন। সেজন্যই আমার এই ব্যক্ত হয়ে আসা ও রাগের কারণ। আমি পুত্র- বাৎসল্যে শাপদাতা সূর্যকে বিনাশ করতে উদ্যত হলে, সূর্য বিধাতার শরণ গ্রহণ করেন এবং ব্রহ্মা সূর্যসহ আপনার শরণাপন্ন হয়েছেন। যারা কথায় এবং ধ্যানের দ্বারাও আপনার শরণাপন্ন হয়, তারা নিরাপদ ও শঙ্কাহীন হয়ে জরা-মৃত্যুকেও জয় করে। হে প্রভু, কিন্তু যারা সাক্ষাৎ আপনার শরণাপন্ন হয়, তাদের যে কি ফল, তা আর কি বলব !! হরির স্মরণ অভয় ও সকল রকমের মঙ্গল প্রদান করে। হে জগতের প্রভু, সূর্যের শাপে হতশ্রী আমার এই মূঢ় ভক্তের কি গতি হবে ?
দেবী তুলসীর পুর্বপুরুষদের অভিশাপ মুক্তির উপায়ে পথ
তাঁর কথা শুনে ভগবান বললেন – বৈকুণ্ঠের আধ ঘণ্টা সময়ে দৈব একুশ যুগ অতীত হয়ে গেছে। তুমি তাড়াতাড়ি রাজার ভবনে ফিরে যাও। বৃষধ্বজ দুর্নিবার্য সুদারুণ কালের প্রভাবে মারা গেছে। তার হংসধ্বজ নামে যে পুত্র ছিল সেও শ্রীহীন হয়ে কালক্রমে মারা গেছে। তার পুত্র ধর্মধ্বজ ও কুশধ্বজ। তারা পরম বৈষ্ণব। কিন্তু সূর্যশাপে তারাও হতশ্রী হল । তারা রাজ্যভ্রষ্ট ও শ্রীভ্রষ্ট হয়ে কমলার উপাসনা করতে থাকলে তাদের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে লক্ষ্মী তাদের দুই স্ত্রীর গর্ভে অংশত অবতীর্ণা হবেন। সে সময়ে সেই দুইরাজা সম্পদযুক্ত ও শ্রীযুক্ত হবে। হে শম্ভো, তুমি যাও, তোমার ভক্ত মারা গেছে। সূর্য,ব্রহ্মা তোমরাও যাও। একথা বলে ভগবান লক্ষ্মীসহ সভা থেকে নিজস্থানে চলে গেলেন। দেবতারাও আনন্দিত মনে নিজ আশ্রমে গেলেন এবং মহাদেবও শীঘ্র তপস্যার জন্য পরিপূর্ণ ধামে গমন করলেন ।
দেবী তুলসীর ভাগ্নির জন্ম কথা
নারায়ণ বলেন, রাজপুত্র ধর্মধ্বজ ও কুশধ্বজ উগ্র তপস্যায় লক্ষ্মীকে আরাধনা করে নিজ নিজ অভিপ্রেত বর লাভ করলেন। মহালক্ষ্মীর বরের প্রভাবে তাঁরা ধনবান, পুত্রবান ও পৃথিবীর অধীশ্বর হলেন । তারপর কুশধ্বজের স্ত্রী মালাবতী কালক্রমে লক্ষ্মীর অংশরূ পিণী এক কন্যার জন্ম দেন। সেই কন্যা ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র উত্তমজ্ঞান সম্পন্না হয়ে সূতিকাগারে স্পষ্ট বেদধ্বনি করেন। ইনিই বেদবতী। এই বেদবতীই একটু বড় হয়ে পুষ্করতীর্থে গিয়ে নারায়ণের জন্য কঠোর তপস্যা করেন। সেই তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে তিনি ব্রহ্মার বরলাভ করেন “জন্মান্তরে হরিকে পতিরূপে লাভ করিবে।
” কিন্তু তিনি সেই বরে সন্তুষ্টা না হয়ে গন্ধমাদনে তপস্যা আরম্ভ করেন। সে-সময় রাবণ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে পেতে চায় । বেদবতী সে – সময় রাবণকে অভিশাপ দেন—তুমি আমার অভিশাপের জন্য সবান্ধবে বিনষ্ট হবি। এবং রাবণ তাঁর শরীর স্পর্শ করায় তিনি যোগবলে দেহত্যাগ করেন। এই বেদবতীই পুনরায় রাজা জনকের ঘরে সীতারূপে জন্মগ্রহণ করেন। সীতার জন্যই যে রাবণ সবংশে নিধন হয় সে- কাহিনী আমরা রামায়ণ থেকে জেনেছি ।
দেবী তুলসী জন্ম কাহিনী
এবার লক্ষ্মীর অপর অংশের কাহিনী আমরা নারায়ণের কাছ থেকে শুনি – ধর্মধ্বজ রাজার মাধবী নামে স্ত্রী ছিলেন। তিনি শুভ ক্ষণে, শুভ দিনে, শুভ যোগে, শুভ লগ্নে, শুভ অংশে মনোহর স্বামীগৃহে কার্তিকী পূর্ণিমাতে শুক্রবারে লক্ষ্মীর অংশরূপিণী মনোহরা এক পদ্মিনী কন্যার জন্ম দেন। তাঁর পাদপদ্মে পদ্মচিহ্ন বিরাজিত। তাঁর অঙ্গে রাজরাজেশ্বরী লক্ষ্মীর ভঙ্গিমা প্রকাশ পেতে লাগল। তিনি রাজলক্ষ্মী-চিহ্নযুক্তা ও রাজলক্ষ্মীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাঁর মুখমণ্ডল শরৎকালের চাঁদের মত মনোহর। লোচন শরৎকালের বিকশিত পদ্মের মত । তাঁর হাত ও পায়ের তল রক্তিম। তাঁর সর্বাঙ্গের অতি উত্তম লক্ষণসকল দেখে নরনারিগণ তাঁর তুলনা দিতে অক্ষম বলে পুরাবিদগণ তাঁকে তুলসী নামে অভিহিত করলেন।
দেবী তুলসীর তপস্যার
তুলসী জন্ম কাহিনী:- তুলসী ভূমিষ্ঠ হয়েই ব্রহ্মার দেওয়া প্রকৃতি মত সকলের বারণ উপেক্ষা করে বদরী তপোবনে তপস্যার জন্য চলে গেলেন। সেখানে তপস্যা করতে বসে “নারায়ণ কে যেন তিনি স্বামী রুপে পান” মনে মনে এই সঙ্কল্প করে দৈব-পরিমাণে লক্ষ বছর তপস্যা করতে লাগলেন। গরমের সময় পঞ্চতপা, শীতের সময় জলে থেকে এবং বর্ষার সময় শ্মশানে থেকে নিরন্তর বর্ষার ধারা সহ্য করে তপস্যা করতে লাগলেন।
সেই তপস্বিনী কুড়ি হাজার বছর ফল ও জল খেয়ে, ত্রিশ হাজার বছর গলে যাওয়া পাতা খেয়ে, চল্লিশ হাজার বছর বায়ু ভক্ষণ করে এবং দশ হাজার বছর নিরাহারে তপস্যা করলেন। তারপর ব্রহ্মা তাঁকে নিশ্চিত লক্ষ্যে অবিচল ও এক পায়ে অবস্থিতা দেখে বরপ্রদান করার জন্য সেই বদরিকাশ্রমে গেলেন। তখন তপস্বিনী তুলসী, হংসবাহন ব্রহ্মাকে সামনে দেখে প্রণাম করলেন। জগতের বিধাতা তাঁকে বলতে লাগলেন – তুলসি, তুমি বর প্রার্থনা কর । হরিভক্তি, মুক্তি কিংবা অজর-অমরতা এর যেটি তোমার ইচ্ছা হয় সেই বরই তোমাকে দেব।
রাধারানী তুলসী দেবীকে যে কারণে অভিশাপ
তুলসী বললেন – তাত, আমার যা আকাঙ্ক্ষা তা আপনাকে বলছি। আপনি সবই জানেন, সুতরাং আপনার কাছে বলতে আমার কোন লজ্জা নেই। আমি তুলসী, আমি আগে গোলোকে গোপিকা ছিলাম। শ্রীকৃষ্ণের কিঙ্করী হয়ে সব সময় তাঁর সেবা করতাম। আমি রাধার অংশসম্ভূতা এবং প্রিয়তমা সখী ছিলাম। এক সময় আমি রাসমণ্ডলে গোবিন্দ- সহ ক্রীড়া কৌতুক ভোগ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। সে সময় রাসেশ্বরী রাধিকা হঠাৎ সেখানে এসে আমাকে ওই অবস্থায় দেখেন।
হে পিতামহ, তখন তিনি অত্যন্ত রাগে অন্ধ হয়ে, গোবিন্দকে বহু ভর্ৎসনা করেন এবং আমাকে শাপ দেন— “পাপিষ্ঠে, তুই মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ কর।” এরকম সময়ে গোবিন্দ আমাকে বললেন – “গোপিকে, তুমি ভারতে তপস্যা করে, ব্রহ্মার বরে আমার অংশরূপ চতুর্ভুজকে লাভ করবে।” এই কথা বলেই তিনি অন্তর্হিত হলেন। আমিও দেবীর ভয়ে দেহত্যাগ করে ভারতে জন্মগ্রহণ করলাম ।
ব্রহ্মার কাছে তুলসী দেবীর বর প্রার্থনা
হে ভগবান, অতএব আমি সেই কমনীয়রূপ সুন্দর এবং শান্ত নারায়ণকে লাভ করতে ইচ্ছা করি, সেই বরই আপনি আমাকে প্রদান করুন । ব্রহ্মা বললেন সুন্দরি, কৃষ্ণের অঙ্গ থেকে উদ্ভুত এবং তাঁর অংশস্বরূপ ও অত্যন্ত তেজস্বী সুদামা নামে গোপ ভারতে জন্মগ্রহণ করে ত্রিভুবনে শঙ্খচূড় নামে বিখ্যাত হয়েছে। সেই সুদামা আগে গোলোকে তোমাকে দেখে অত্যন্ত কামপীড়িত হয়েছিল। কিন্তু রাধিকার প্রভাবে ভয় পেয়ে তোমাকে লঙ্ঘন করতে সক্ষম হয়নি। সেই জাতিস্মর শঙ্খচূড় তপস্যা করে, আমার বরে তোমাকেই লাভ করবে। অতএব সুন্দরি ; তুমিও জাতিস্মরা, সবই জান। তাহলে তুমি তারই স্ত্রী হও।
এর পরে নারায়ণকে স্বামীরূপে লাভ করবে। তুমি দৈবযোগে নারায়ণের শাপ বশতঃ অংশরূপে বিশ্বপাবনী বৃক্ষরূপা হবে। তুমি জগতে সকল পুষ্পের প্রধানা ও বিষ্ণুর প্রাণাধিকা হবে। তোমাকে ছাড়া সকল দেবতার পূজাই বৃথা হবে। তুমি বৃন্দাবনে বৃন্দাবনী নামে বৃক্ষরূপে অবস্থান করবে এবং তোমার পাতা দিয়ে গোপ -গোপিকাগণ মাধবকে পুজা করবে। তুমি বৃক্ষের অধিষ্ঠাতৃ দেবীরূপে আমার বরে নিরন্তর গোপ বেশধারী শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে বিরাজ করবে।
দেবী তুলসীর বর সরূপ শ্রীকৃষ্ণ চাওয়া
একথা শুনে তুলসী সম্মত হয়ে আনন্দিত অন্তরে ব্রহ্মাকে প্রণাম করে বললেন – হে তাত, আমার দ্বিভুজ শ্যাম-সুন্দর শ্রীকৃষ্ণই অভিলষিত। সেটি সত্যই বলেছেন। কিন্তু সেরকম বাঞ্ছা চতুর্ভুজে নয়। কিন্তু গোবিন্দের সঙ্গে লীলার সময় আমি অজ্ঞান হয়েছিলাম সুতরাং আমি আবার চতুর্ভুজ গোবিন্দকেই প্রার্থনা করছি। যদি আপনার কৃপায় সুদুর্লভ গোবিন্দকে লাভ করি, তাহলে আগে আমার রাধা-ভয় দূর করুন। ব্রহ্মা বললেন – এই ষোল অক্ষর রাধিকা-মন্ত্র দান করছি। এটি জপ করলে তুমি রাধিকার প্রাণতুল্যা হবে এবং তাঁর জন্য তোমার আর কোন ভয় থাকবে না। একথা বলেই – জগৎ-কর্তা দেবীর ষোল অক্ষর মন্ত্র, স্তোত্র, কবচ এবং সমস্ত পূজাবিধান ও পুরশ্চরণ ক্রম তাঁকে বলে ও আশীর্বাদ করে অন্তর্ধান হলেন।
তারপর তুলসী ব্রহ্মার উপদেশ মত সেই পবিত্র বদরিকাশ্রমে পূর্বজন্মের অভীষ্টমন্ত্র জপ করতে লাগলেন। সেখানে বার বছর জপ ও পূজা করে মন্ত্র-সিদ্ধা হলে তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হল। তাঁর তপস্যা ও মন্ত্রসিদ্ধির ফলে তিনি নিজ আকাঙ্ক্ষিত বর লাভ করে বিশ্বদুর্লভ মহাভাগ্যফল ভোগ করতে লাগলেন। অতঃপর তুলসীর সুখে দিন কাটতে লাগল।
তুলসী জন্ম কাহিনী: পরবর্তী অংশ
আধ্যাত্মিক পথে উন্নতি করতে আমাদের অন্যান্য পোস্ট গুলো পড়ুন:-
FAQ:-দেবী তুলসী জন্ম কাহিনী সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন
প্রশ্ন:- তুলসী দেবীর বাবার নাম কি ?
উত্তর :- দেবী তুলসীর বাবার নাম ধর্মধ্বজ ছিল তিনি পরম বৈষ্ণব ছিলেন।
প্রশ্ন:- তুলসী দেবীর স্বামীর নাম কি ?
উত্তর :-তুলসী দেবীর স্বামীর নাম শঙ্খচূড় ছিল, যিনি পূর্বজন্মে সুদামা নামে গোলোকে এক গোপ ছিলেন।
প্রশ্ন:- তুলসী দেবী কে ?
উত্তর :- দেবী তুলসী গোলোকে গোপিকা ছিলাম, যিনি শ্রীকৃষ্ণের কিঙ্করী হয়ে সব সময় তাঁর সেবা করতেন এবং তিনি রাধারানীর অংশসম্ভূতা এবং প্রিয়তমা সখী ছিলাম।
প্রশ্ন:- শঙ্খচূড় কে ছিলেন ?
উত্তর :- শঙ্খচূড় ছিলেন কৃষ্ণের অঙ্গ থেকে উদ্ভুত এবং তাঁর অংশস্বরূপ ও অত্যন্ত তেজস্বী সুদামা নামে গোলোকে এক গোপ ছিলেন।