কৃষ্ণাষ্টকম: শ্রীকৃষ্ণ ভক্তির এক মহামূল্যবান স্তোত্র অর্থ সমেত

Share Please:

হিন্দু ধর্মে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষোত্তম রূপে মানা হয়। তাঁর লীলাময় চরিত্র, ভক্তদের প্রতি অপরিসীম করুণা এবং ধর্মরক্ষার বার্তা যুগে যুগে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। কৃষ্ণকে নিবেদিত বহু স্তোত্র ও ভজনের মধ্যে “কৃষ্ণাষ্টকম” বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। এটি এক প্রাচীন সংস্কৃত স্তোত্র যেখানে আটটি শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণের রূপ, গুণ এবং লীলার মহিমা বর্ণিত হয়েছে।

কৃষ্ণাষ্টকম

শ্রীকৃষ্ণ অষ্টকম কী?

‘অষ্টক’ মানে হলো আটটি স্তবক বা শ্লোক। কৃষ্ণাষ্টকম মূলত, যেখানে শ্রীকৃষ্ণের সৌন্দর্য, দয়াময় স্বভাব ও ভক্তদের রক্ষাকারী রূপ অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। প্রতিটি শ্লোক ভক্তিকে গভীর করে এবং পাঠকের মনে কৃষ্ণভক্তির স্রোত বইয়ে দেয়।


শ্রীকৃষ্ণাষ্টকম

বসুদেবসুতং দেবং কংসচাণূরমর্দনম্ ।
দেবকীপরমানন্দং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্ ॥ ১॥

আতসীপুষ্পসংকাশম্ হারনূপুরশোভিতম্ ।
রত্নকণ্কণকেয়ূরং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্ ॥ ২॥

কুটিলালকসংযুক্তং পূর্ণচন্দ্রনিভাননম্ ।
বিলসত্কুণ্ডলধরং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্ ॥ ৩॥

মন্দারগন্ধসংয়ুক্তং চারুহাসং চতুর্ভুজম্ ।
বর্হিপিঞ্ছাবচূড়াঙ্গং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্ ॥ ৪॥

উত্ফুল্লপদ্মপত্রাক্ষং নীলজীমূতসন্নিভম্ ।
যাদবানাং শিরোরত্নং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্ ॥ ৫॥

রুক্মিণীকেলিসংযুক্তং পীতাংবরসুশোভিতম্ ।
অবাপ্ততুলসীগন্ধং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্ ॥ ৬॥

গোপিকানাং কুচদ্বন্দ্ব কুংকুমাঙ্কিতবক্ষসম্ ।
শ্রী নিকেতং মহেষ্বাসং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্ ॥ ৭॥

শ্রীবত্সাঙ্কং মহোরস্কং বনমালাবিরাজিতম্ ।
শঙ্খচক্রধরং দেবং কৃষ্ণং বন্দে জগদ্গুরুম্ ॥ ৮॥

কৃষ্ণাষ্টকমিদং পুণ্যং প্রাতরুত্থায় য়ঃ পঠেত্ ।
কোটিজন্মকৃতং পাপং স্মরণেন বিনষ্যতি ॥


শ্রী কৃষ্ণাষ্টকমের বাংলা ভাবার্থ

হে ভগবান! আপনি বসুদেবের পুত্র, কংস ও চাণূরের বিনাশকারী। দেবকী মায়ের আনন্দের উৎস আপনি। হে জগদ্গুরু শ্রীকৃষ্ণ, আমি ভক্তিভরে আপনাকে প্রণাম জানাই।

আপনার দেহের আভা অতসী ফুলের মতো দীপ্তিমান। গলায় মুক্তোর হার, হাতে রত্নখচিত কঙ্কণ, বাহুতে বাজুবন্ধ, আর পায়ে ঝংকারময় নূপুরে আপনি সুশোভিত। হে জগদ্গুরু শ্রীকৃষ্ণ, আমি আপনার বন্দনা করি।

আপনার কেশ কোঁকড়ানো, শ্রীমুখ পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল, আর কর্ণে দুলছে মনোরম কুন্ডল। হে জগদ্গুরু শ্রীকৃষ্ণ, আমি আপনার বন্দনা করি।

আপনার দেহ থেকে ভেসে আসে মন্দার ফুলের মনোরম সুগন্ধ। মুখে আছে মৃদু হাসি, হাতে চতুর্ভুজ রূপ, আর মস্তকে শোভিত ময়ূরপঙ্খী মুকুট। হে জগদ্গুরু শ্রীকৃষ্ণ, আমি আপনার বন্দনা করি।

আপনার চোখ প্রস্ফুটিত পদ্মদলের মতো সুন্দর। গাত্রকান্তি কালো মেঘের মতো গাঢ় নীল। আপনি যাদববংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ। হে জগদ্গুরু শ্রীকৃষ্ণ, আমি আপনার বন্দনা করি।

হে প্রভু! আপনি রুক্মিণী দেবীর সঙ্গে ক্রীড়ামগ্ন। আপনার পরিধান পীতাম্বর, আর তুলসীর গন্ধ আপনাকে আনন্দিত করে। হে জগদ্গুরু শ্রীকৃষ্ণ, আমি আপনার বন্দনা করি।

আপনার অঙ্গ কুমকুমে রঞ্জিত, যা গোপিনীদের প্রেমালিঙ্গনের স্মৃতি বহন করে। আপনার মধ্যেই মহালক্ষ্মীর আবাস। আপনার হাতে রয়েছে অপ্রতিরোধ্য ধনু-বাণ। হে জগদ্গুরু শ্রীকৃষ্ণ, আমি আপনার বন্দনা করি।

আপনার বুকে শ্রীবৎস চিহ্ন সুস্পষ্ট। আপনি নিজ আনন্দে নিমগ্ন। গলায় শোভিত বনমালা, আর হাতে রয়েছে শঙ্খ ও চক্র। হে জগদ্গুরু শ্রীকৃষ্ণ, আমি আপনার বন্দনা করি।

যে ভক্ত প্রত্যুষে এই পবিত্র কৃষ্ণাষ্টকম শ্রদ্ধাভরে পাঠ করে, তার অগণিত জন্মের পাপ ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়।


শ্রীকৃষ্ণাষ্টকম পাঠের নিয়ম

শাস্ত্র অনুসারে কৃষ্ণাষ্টকম পাঠ করার নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, তবে ভক্তিভরে উচ্চারণ করাই মূল কথা। কিছু সাধারণ নিয়ম নিচে দেওয়া হলো:

  • ভোরবেলা স্নান শেষে পরিষ্কার স্থানে বসে পাঠ করা শ্রেয়।
  • পাঠের আগে ভগবান কৃষ্ণের ছবি বা মূর্তিতে প্রদীপ ও ধূপ জ্বালান।
  • প্রতিদিন বা অন্তত বৃহস্পতিবার ও একাদশীতে কৃষ্ণাষ্টকম পাঠ করলে বিশেষ ফল লাভ হয়।
  • পাঠের সময় মনকে একাগ্র করে শুধু কৃষ্ণভাবনায় ডুবে থাকুন।

শ্রীকৃষ্ণাষ্টকম পাঠের উপকারিতা

ভক্তরা বিশ্বাস করেন, নিয়মিত কৃষ্ণাষ্টকম পাঠ করলে—

  • জীবনে শান্তি ও সুখের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
  • মানসিক অশান্তি, দুঃখ ও ভয় দূর হয়।
  • সংসারে সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য আসে।
  • ভক্তের মনে কৃষ্ণপ্রেম বৃদ্ধি পায় এবং আত্মার মুক্তির পথ সহজ হয়।
  • শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদে বাধা-বিপত্তি সহজে কেটে যায়।

আধ্যাত্মিক গুরুত্ব

শ্রীকৃষ্ণকে গোপাল, মাধব, গোবিন্দ ইত্যাদি নানা নামে ডাকা হয়। কৃষ্ণাষ্টকমে প্রতিটি শ্লোকেই এই নামগুলোর মাহাত্ম্য প্রকাশ পেয়েছে। ভক্ত যখন এই স্তোত্র পাঠ করেন, তখন তিনি কৃষ্ণের নানা রূপকে স্মরণ করেন এবং তাঁর সান্নিধ্য অনুভব করেন।


উপসংহার

শ্রীকৃষ্ণাষ্টকম কেবল একটি স্তোত্র নয়, বরং ভক্তের হৃদয়ে কৃষ্ণপ্রেম জাগিয়ে তোলার এক মহৌষধ। সহজ ভাষায় বললে—ভগবান কৃষ্ণকে স্মরণ করার এক সুন্দর উপায়। যে কেউ ভক্তিভরে প্রতিদিন কয়েক মিনিট কৃষ্ণাষ্টকম পাঠ করলে জীবনের অন্ধকার দূর হয়ে শান্তি, প্রেম ও ভক্তির আলোয় ভরে উঠবে।


আরো অন্যান্য আধ্যাতিক পোস্ট গুলো পড়ুন:-

Share Please:
অস্বীকৃতি

এই লেখা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক তথ্য সরবরাহের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। এতে বর্ণিত পুজা পদ্ধতি, মন্ত্র এবং অন্যান্য তথ্য প্রাচীন শাস্ত্র, লোকাচার ও ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে। পাঠকদের অনুরোধ করা হচ্ছে, নিজের বিশ্বাস ও সুবিধা অনুযায়ী পুজা পদ্ধতি গ্রহণ করুন। যেকোনো ধর্মীয় কাজ করার আগে যোগ্য পণ্ডিত বা বিদ্বান থেকে পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই লেখায় দেওয়া তথ্য ব্যবহারের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারকারীর ওপর থাকবে।

আপনার মতামত জানাতে এবং নতুন ধর্মীয় পোস্টের আপডেট পেতে WhatsApp গ্রুপে যোগ দিন! Join Now

নমস্কার! আমি শ্রী গোপাল চন্দ্র — একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু সনাতনী। আমি বিগত সাত বছরের ও অধিক সময় ধরে, হিন্দু ধর্ম, সনাতন সংস্কৃতি এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য নিয়ে নিয়মিতভাবে অনুশীলন ও লেখালেখি করে আসছি। আমি হিন্দু ধর্মের প্রাচীন ঐতিহ্য, ধর্মগ্রন্থ, এবং আধ্যাত্মিকতার জ্ঞান সহজ ভাষায় উপস্থাপন করার চেষ্টা করি, যাতে সকলেই এই মহান ধর্মের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি যে সনাতন ধর্ম শুধু একটি ধর্ম নয়, এটি একটি জীবনধারা, যা আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং জীবনের প্রকৃত অর্থ বোঝায়।"

Leave a Comment