অপরা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য:অপরা একাদশী এক অনন্য তিথি, যেখানে শাস্ত্র মতে এমনকি ব্রহ্মহত্যার মতো মহাপাপও মোচন হয় – যদি ভক্ত শ্রদ্ধা সহকারে উপবাস পালন করেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে এই ব্রতের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে বলেন যে, অপরা একাদশীর উপবাস ও পূজার মাধ্যমে জন্মজন্মান্তরের পাপ ধুয়ে যায় এবং ভক্ত বিষ্ণুলোকে অধিষ্ঠিত হয়। এই ব্রত শুধু শুদ্ধতা অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং মোক্ষের পথে এক নিশ্চিত পদক্ষেপ।

অপরা একাদশী ব্রত কথা জ্যৈষ্ঠ মাসের একাদশীর
অপরা একাদশী হল জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী, যা হিন্দু ধর্মে অন্যতম ফলদায়ক ও পাপক্ষয়কারী ব্রত হিসেবে পরিগণিত। এই ব্রতের মাহাত্ম্য ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। নিচে শ্রীকৃষ্ণ ও মহারাজ যুধিষ্ঠিরের মধ্যে সংঘটিত এক ঐশ্বরিক সংলাপের মাধ্যমে আমরা এই ব্রতের গুরুত্ব জানতে পারি।
যুধিষ্ঠিরের প্রশ্ন
একদিন মহারাজ যুধিষ্ঠির শ্রীকৃষ্ণের কাছে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করেন:
“হে কৃষ্ণ! জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশীর নাম কী? এই ব্রতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে আমি বিস্তারিত জানতে আগ্রহী। অনুগ্রহ করে আমায় বলুন।”
শ্রীকৃষ্ণের উত্তর
শ্রীকৃষ্ণ বললেন:
“হে রাজন! আপনি এমন একটি প্রশ্ন করেছেন যা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ সাধনে সহায়ক। এই একাদশী ব্রতের নাম ‘অপরা একাদশী’। এটি এমন একটি ব্রত যা অসীম পুণ্য প্রদানকারী এবং ভয়ংকর পাপ ধ্বংসকারী। এই ব্রতের নিয়ম অনুসারে উপবাস পালন করলে ব্যক্তি মহাপাপ থেকেও মুক্তি লাভ করেন এবং ঈশ্বরের কৃপায় স্বর্গগমন করেন।
এই ব্রত পালন করলে যেসব গুরুতর পাপ ধ্বংস হয় তা হল:
- ব্রাহ্মণ হত্যা
- গোহত্যা (গরু হত্যা)
- গর্ভপাতে সহায়তা করা
- মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান
- অপরের দোষচর্চা বা নিন্দা
- পরনারী গমন
- শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান
- মিথ্যা জ্যোতিষ গণনা
- ওজনে প্রতারণা
- ভুল চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি করা
এমনকি যে ক্ষত্রিয় যুদ্ধে পালিয়ে যায় এবং স্বধর্ম ত্যাগ করে, সেও যদি এই ব্রত পালন করে, তবে সে ভয়ংকর নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়।
ব্রতের ফলাফল ও তুলনা
শ্রীকৃষ্ণ আরও বলেন:
“এই ব্রতের মাধ্যমে যে ফল লাভ হয় তা নিচের কার্যগুলোর সমান:
- মাঘ মাসে প্রয়াগে স্নান
- মহাশিবরাত্রিতে বারাণসীতে উপবাস
- গয়ায় বিষ্ণুপাদে পিণ্ডদান
- সিংহ রাশিতে বৃহস্পতির অবস্থানে গৌতমী নদীতে স্নান
- কুম্ভ মেলায় কেদারনাথ দর্শন
- বদরিকাশ্রম যাত্রা ও বদ্রীনারায়ণ সেবা
- সূর্যগ্রহণের সময় কুরুক্ষেত্রে স্নান এবং
- হস্তী, ঘোড়া, স্বর্ণ দানসহ বৃহৎ যজ্ঞ সম্পাদন
এই সমস্ত পুণ্য অপরা একাদশীর ব্রতের মাধ্যমে একসঙ্গে লাভ হয়।”
পাপ নাশকারী রূপে অপরা একাদশী
“এই ব্রত পাপরূপ বৃক্ষের জন্য কুঠার,
পাপরূপ কাঠের জন্য দাবানল,
অন্ধকারের জন্য সূর্য এবং
পাপরূপ হাতির জন্য সিংহের মতো।
যে ব্যক্তি এই ব্রত পালন না করে জীবন কাটায়, সে জলের বুদবুদের মতো – অস্থায়ী এবং অর্থহীন। কিন্তু যে ভক্ত মন দিয়ে এই ব্রত পালন করে এবং শ্রীহরির পূজা করে, সে সর্ব পাপ থেকে মুক্তি পায় এবং বিষ্ণুলোক লাভ করে।”
শ্রবণ ও পাঠের পুণ্য
শ্রীকৃষ্ণ বললেন:
“এই ব্রতের কাহিনী যে পাঠ করে বা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে, সে সহস্র গোধানের (হাজার গরু দান) পুণ্য লাভ করে।”
এই মহাপবিত্র অপরা একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে বর্ণিত হয়েছে এবং এর দ্বারা জীবনের সকল পাপ বিনষ্ট হয়।
অপরা একাদশী ব্রত উপবাস বিধি
- একাদশীর দিন সূর্যোদয় থেকে পরদিন সূর্যোদয় পর্যন্ত জল গ্রহণ না করে উপবাস করতে হয়।
- পরদিন দ্বাদশীতে ব্রাহ্মণদের জল ও সোনাদান করতে হয়।
- সন্ধ্যায় নিজে আহার গ্রহণ করতে হয়।
অপরা একাদশীর দিনে করণীয়
- বিষ্ণুর পুজো ও নামসংকীর্তন করা।
- রাত্রি জাগরণ করা।
- মধুর জল, মিষ্টান্ন, বস্ত্র, জুতো, ছাতা, শয্যা ইত্যাদি দান করা।
- জলময়, ঘৃতময় বা বাস্তব গোমাতা দান করা।
অপরা একাদশীর ফলে যা লাভ হয়
- সব পাপ নাশ হয়, এমনকি ব্রহ্মহত্যা বা গুরুদ্রোহের মতো গুরুতর পাপও।
- ১০০ পূর্বপুরুষ ও ১০০ ভবিষ্যৎ বংশধর মুক্তি লাভ করে।
- মৃত্যুর পর বিষ্ণুদূতের সহায়তায় ভগবান বিষ্ণুর পারম ধামে গমন ঘটে।
- পাণ্ডবদের মধ্যে ভীম এই ব্রত পালন করতেন, তাই এটি ‘পাণ্ডব-একাদশী’ নামেও পরিচিত।
অপরা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য উপসংহার:
আপরা ও নির্জলা একাদশী — মহাপবিত্র একাদশী। যারা মন থেকে এই ব্রত পালন করেন, তারা সকল পাপমুক্ত হয়ে স্বর্গ এবং মোক্ষ লাভ করেন। হিন্দু ধর্মে একাদশী একটি শক্তিশালী আত্মিক উপাসনার মাধ্যম। ভক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে এই ব্রত পালন করলে জীবনের সমস্ত ক্লেশ ও বন্ধন বিনষ্ট হয়।
হরে কৃষ্ণ! হরে রাম!
একাদশী ব্রত সম্পর্কে কিছু উপকারী পোস্ট:-
*একাদশী ব্রতের খাদ্যতালিকা গ্রহণযোগ্য ও নিষিদ্ধ খাবারের পূর্ণাঙ্গ গাইড।