পঞ্চতত্ত্ব বন্দনা কীর্তন লিরিক্স – পঞ্চতত্ত্বের কৃপা পেতে বন্দনা করুন এই কীর্তন

পঞ্চতত্ত্ব বন্দনা কীর্তন লিরিক্স: পঞ্চতত্ত্ব বন্দনা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্তব, যা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং তাঁর চার অনুচর ভক্তকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া হয়। এই পাঁচ মহান আত্মা—চৈতন্য, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত আচার্য, গদাধর পণ্ডিত এবং শ্রীবাস ঠাকুর—একসাথে “পঞ্চতত্ত্ব” নামে পরিচিত। তাঁদের সম্মিলিত শক্তি এবং কৃপা লাভের আশায় এই বন্দনাটি পাঠ করা হয়।

এই কীর্তন সাধারণত নামসংকীর্তন বা হরিনাম জপের আগে গাওয়া হয়, কারণ এর মাধ্যমে ভক্তির পরিবেশ তৈরি হয় এবং হরিনামের ফল বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এই বন্দনায় শুধুমাত্র পঞ্চতত্ত্ব নয়, বরং গৌড়ীয় বৈষ্ণব পরম্পরার বহু শ্রেষ্ঠ ভক্ত ও আচার্যের নাম উল্লেখ থাকে, যাঁদের স্মরণে ভক্তের হৃদয় আরও নির্মল হয়ে ওঠে।চলুন, এই পবিত্র পঞ্চতত্ত্ব বন্দনার মূল লিরিক্স ও তার অর্থ একনজরে জেনে নিই।

পঞ্চতত্ত্ব বন্দনা কীর্তন লিরিক্স

পঞ্চতত্ত্ব বন্দনা কীর্তন লিরিক্স মূল শ্লোক:

।। শ্রীপঞ্চতত্ত্ব বন্দনা।।

জয় জয় নিত্যানন্দাদ্বৈত গৌরাঙ্গ
( নিতাই গৌরাঙ্গ নিতাই গৌরাঙ্গ জয় জয় নিত্যানন্দাদ্বৈত গৌরাঙ্গ )।।

জয় জয় যশোদা-নন্দন শচীসুত গৌরচন্দ্র
জয় জয় রোহিণী-নন্দন বলরাম নিত্যানন্দ ৷৷

জয় জয় মহাবিষ্ণু অবতার শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্র।
জয় জয় গদাধর শ্রীবাসাদি গৌর ভক্তবৃন্দ ৷৷

জয় জয় স্বরূপ রূপ সনাতন রায় রামানন্দ
জয় জয় খণ্ডবাসী নরহরি মুরারি মুকুন্দ ৷৷

জয় জয় পঞ্চপুত্ৰ-সঙ্গে ভজে রায় ভবানন্দ ৷
জয় জয় তিন পুত্র সঙ্গে নাচে সেন শিবানন্দ ৷৷

জয় জয় দ্বাদশ গোপাল আদি চৌষট্টি মহান্ত ৷
জয় জয় ছয় চক্রবর্ত্তী অষ্ট কবিরাজ চন্দ্র ৷৷

জয় জয় হরিদাস বক্রেশ্বর বসু রামানন্দ
জয় জয় সাৰ্ব্বভৌম প্রতাপরুদ্র গোপীনাথাচাৰ্য্য ৷৷

জয় জয় শ্রীনিবাস নরোত্তম প্রভু শ্যামানন্দ
জয় জয় উড়িয়া গৌড়িয়া আদি যত ভক্তবৃন্দ।।

তোমরা সবে মিলি কর কৃপা আমি অতি মন্দ
সবে কৃপা করি দেহ গৌর-চরণারবৃন্দ ৷৷


পঞ্চতত্ত্ব বন্দনা কীর্তন মূল স্তব ও অর্থঃ

জয় জয় নিত্যানন্দাদ্বৈত গৌরাঙ্গ,
(নিতাই গৌরাঙ্গ নিতাই গৌরাঙ্গ জয় জয় নিত্যানন্দাদ্বৈত গৌরাঙ্গ)

অর্থঃ
শ্রীনিত্যানন্দ, শ্রীঅদ্বৈত আচার্য ও শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে আমি কোটিকুটি প্রণাম ও জয় জানাই। (বারবার উচ্চারিত ‘নিতাই গৌরাঙ্গ’ নাম সংকীর্তনে চৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা বর্ষে।)

জয় জয় যশোদা-নন্দন শচীসুত গৌরচন্দ্র।
জয় জয় রোহিণী-নন্দন বলরাম নিত্যানন্দ।

অর্থঃ
যিনি যশোদার পুত্র শ্রীকৃষ্ণ এবং শচীমাতার পুত্র রূপে আবির্ভূত গৌরচন্দ্র, তাঁকে জয় জানাই।
রোহিণী নন্দন বলরাম যিনি, তিনিই নিত্যানন্দ প্রভু — তাঁকেও জয় জানাই।

জয় জয় মহাবিষ্ণু অবতার শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্র।
জয় জয় গদাধর শ্রীবাসাদি গৌর ভক্তবৃন্দ।

অর্থঃ
মহাবিষ্ণুর অবতার শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্রকে জয় জানাই।
গদাধর পণ্ডিত, শ্রীবাস ঠাকুর ও অন্যান্য গৌরভক্তবৃন্দকেও কৃতজ্ঞচিত্তে প্রণাম ও জয় জানাই।

জয় জয় স্বরূপ রূপ সনাতন রায় রামানন্দ।
জয় জয় খণ্ডবাসী নরহরি মুরারি মুকুন্দ।

অর্থঃ
শ্রীস্বরূপ দামোদর, রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, রায় রামানন্দ — সকল মহাভাগবতদের আমি জয় জানাই।
খণ্ডভূমির বাসিন্দা নরহরি, মুরারি গুপ্ত ও মুকুন্দ দত্তকেও প্রণাম জানাই।

জয় জয় পঞ্চপুত্ৰ-সঙ্গে ভজে রায় ভবানন্দ।
জয় জয় তিন পুত্র সঙ্গে নাচে সেন শিবানন্দ।

অর্থঃ
যিনি তাঁর পাঁচ পুত্রসহ শ্রীগৌরাঙ্গকে ভজনা করেন, সেই রায় ভবানন্দকে জয় জানাই।
তিন পুত্রসহ নৃত্যে আনন্দিত শিবানন্দ সেনকেও জয় জানাই।

জয় জয় দ্বাদশ গোপাল আদি চৌষট্টি মহান্ত।
জয় জয় ছয় চক্রবর্ত্তী অষ্ট কবিরাজ চন্দ্র।

অর্থঃ
দ্বাদশ গোপাল (শ্রীগৌরাঙ্গের বারো জন অন্তরঙ্গ সঙ্গী) ও চৌষট্টি মহান্ত বা আচার্য্যদের জয় জানাই।
ছয়জন চক্রবর্ত্তী এবং আটজন কবিরাজ (বিশিষ্ট ভক্ত ও সাধক) এর প্রতি জয়ধ্বনি।

জয় জয় হরিদাস বক্রেশ্বর বসু রামানন্দ।
জয় জয় সাৰ্ব্বভৌম প্রতাপরুদ্র গোপীনাথাচাৰ্য্য।

অর্থঃ
শ্রীহরিদাস ঠাকুর, বক্রেশ্বর পণ্ডিত, বসু ও রামানন্দ রায় — সকলকে জয় জানাই।
সর্বরভৌম ভট্টাচার্য, রাজা প্রতাপরুদ্র ও গোপীনাথ আচার্য্যকেও কৃতজ্ঞচিত্তে জয় জানাই।

জয় জয় শ্রীনিবাস নরোত্তম প্রভু শ্যামানন্দ।
জয় জয় উড়িয়া গৌড়িয়া আদি যত ভক্তবৃন্দ।

অর্থঃ
শ্রীনিবাস আচার্য, নরোত্তম দাস ঠাকুর ও শ্যামানন্দ প্রভুকে জয় জানাই।
উড়িয়া (উড়িষ্যার) এবং গৌড়ীয় (বাংলার) সমস্ত প্রাচীন ভক্তদের কৃতজ্ঞচিত্তে জয় জানাই।

তোমরা সবে মিলি কর কৃপা আমি অতি মন্দ।
সবে কৃপা করি দেহ গৌর-চরণারবৃন্দ।

অর্থঃ
হে প্রভুগণ! আমি তো অতি মন্দ, অজ্ঞ ও অযোগ্য।
তোমরা সবাই দয়া করে আমায় কৃপা দান করো, গৌরচাঁদের চরণধূলি আমার ভাগ্যে দাও।


পঞ্চতত্ত্ব কারা?

রূপপরিচয়
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুস্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, ভগবানের অবতার
প্রভু নিত্যানন্দশ্রীবলরামজীর অবতার
শ্রীঅদ্বৈত আচার্যশ্রীমহাবিষ্ণুর অংশ
গদাধর পণ্ডিতশ্রীমতীরাধার মূর্তিমান প্রকাশ
শ্রীবাস ঠাকুরভক্তশ্রেষ্ঠ নারদের অংশ

কেন পাঠ করা হয় এই কীর্তন?

শ্রীপঞ্চতত্ত্ব বন্দনা কীর্তন কেবল একটি স্তব বা গীত নয়—এটি ভক্তির দ্বার উন্মোচনের এক মহান সোপান। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতে, যেকোনো ভক্তিমূলক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে হরিনাম সংকীর্তনের সূচনায় এই কীর্তন পাঠ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই শ্লোকের মাধ্যমে ভক্ত স্বয়ং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও তাঁর অনুচর পঞ্চতত্ত্ব—নিত্যানন্দ, অদ্বৈত আচার্য, গদাধর পণ্ডিত, শ্রীবাস ঠাকুর এবং গৌরভক্তবৃন্দের শরণ গ্রহণ করেন।

এই কীর্তন পাঠ করলে সংকীর্তনের ফল অতি দ্রুত ও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। অন্তরে জন্ম নেয় অপার ভক্তি ও পবিত্রতার অনুভূতি। হৃদয় হতে মোহ, অহংকার ও কলুষতা দূর হয়ে যায় এবং পরিবর্তে জাগে বিনয়, প্রেম ও ঈশ্বরভক্তি। যেহেতু এই বন্দনার মাধ্যমে পঞ্চতত্ত্বের কৃপা লাভ সম্ভব হয়, তাই ভক্তজনেরা এ কীর্তনকে নিজেদের দৈনন্দিন সাধনার অপরিহার্য অঙ্গরূপে গ্রহণ করে থাকেন। এই শ্লোক পাঠের মধ্য দিয়েই জপ, কীর্তন বা ভজনের সূচনা করলে তা স্বয়ং শ্রীগৌরাঙ্গের কৃপা দ্বারা পূর্ণতা লাভ করে।

কখন গাওয়া হয়?

  • প্রতিদিন ভোরের মঙ্গলারতি কীর্তনে
  • হরিনাম সংকীর্তনের শুরুতে
  • গৌর পূর্ণিমা, নামযজ্ঞ, বা ভজন সন্ধ্যা উপলক্ষে

উপসংহার:

“শ্রীপঞ্চতত্ত্ব বন্দনা কীর্তন” শুধুমাত্র একটি স্তব নয়—এটি গৌরভক্তির একটি মহান স্তম্ভ এবং হৃদয়ের গভীর ভক্তিভাবের শ্রুতিমধুর প্রকাশ। এই কীর্তনের প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে শ্রীগৌরচাঁদ, নিতাই, অদ্বৈত আচার্য, গদাধর, শ্রীবাস এবং তাঁদের অসংখ্য অনুচর ভক্তদের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছে।

এই বন্দনা পাঠের মাধ্যমে ভক্তের হৃদয় পরিশুদ্ধ হয়, অন্তরে আনন্দ ও শুদ্ধ প্রেম জাগ্রত হয়, এবং গৌর-নিতাই-এর কৃপা লাভের দ্বার উন্মুক্ত হয়।
যদি প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় ভক্তি ভাবে এই কীর্তন গাওয়া হয়, তবে জীবনে ভক্তি, শান্তি ও ঈশ্বরপ্রেম প্রতিষ্ঠিত হয়।

অতএব, এই কীর্তন শুধু মুখে নয়—মন ও প্রাণ দিয়ে গাওয়া উচিত, যাতে আমাদের হৃদয় গৌরচরণে সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত হতে পারে।


আরও পড়ুন:

Share Please:
অস্বীকৃতি

এই লেখা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক তথ্য সরবরাহের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। এতে বর্ণিত পুজা পদ্ধতি, মন্ত্র এবং অন্যান্য তথ্য প্রাচীন শাস্ত্র, লোকাচার ও ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছে। পাঠকদের অনুরোধ করা হচ্ছে, নিজের বিশ্বাস ও সুবিধা অনুযায়ী পুজা পদ্ধতি গ্রহণ করুন। যেকোনো ধর্মীয় কাজ করার আগে যোগ্য পণ্ডিত বা বিদ্বান থেকে পরামর্শ নেওয়া উচিত। এই লেখায় দেওয়া তথ্য ব্যবহারের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারকারীর ওপর থাকবে।

Leave a Comment