দেবী তুলসী বিবাহ কাহিনী: তুলসীর জীবন কাহিনী বৃত্তান্ত

দেবী তুলসী বিবাহ কাহিনী

দেবী তুলসী ও শঙ্খচূড়ের মিলনের কাহিনী

তুলসী বিবাহ কাহিনী:-ব্রহ্মার বরে তৃপ্ত হয়ে দেবী তুলসী স্বামী কৃষ্ণের জন্য অপেক্ষা করছেন, কবে তাঁকে স্বামীরূপে পাবেন। তপস্বিনী তুলসী বড় হয়েছেন, বিবাহযোগ্যাও হয়েছেন। অন্যদিকে, মহাযোগী শঙ্খচূড় কৃষ্ণমন্ত্র লাভ করে পুষ্করতীর্থে সেই মন্ত্রসিদ্ধ হলে নিজ গলায় সর্বমঙ্গল মঙ্গল কবচ ধারণ করে ব্রহ্মার নিকট নিজের মনোমত বর লাভ করে তাঁর আদেশ অনুযায়ী বদরিকাশ্রমে চলে গেলেন।

তিনি তুলসীর স্থানে এসে উপস্থিত হলে নবযৌবন সম্পন্ন শঙ্খচূড়ের অপরূপ রূপ লাবণ্য, অঙ্গকান্তি ও মনোহর সুবেশ দেখে তুলসী অভিভূতা হয়ে পড়েন। পক্ষান্তরে শঙ্খচূড়ও তুলসীর রূপ-যৌবনে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে পড়েন। রাজকুমার তুলসীকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কে? কার কন্যা? ইত্যাদি প্রশ্ন। উত্তরে তুলসী বলেন আমি ধর্মধ্বজ তনয়া। তপস্যার জন্য তপস্বিনী হয়ে এই তপোবনে অবস্থান করছি।

তুলসী শঙ্খচূড়কে জিজ্ঞাসা করেন আপনি কে? শঙ্খচূড় নিজ পরিচয় প্রদান করেন। তারপর উভয়ের মধ্যে নারীচরিত্র সম্বন্ধে বহু জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চলতে থাকে। সে সময়ই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এসে সেখানে উপস্থিত হন। তাঁকে দেখে উভয়ই প্রণাম করেন ।

ব্রহ্মা, শঙ্খচূড় ও দেবী তুলসীকে পরস্পর কে বিবাহ করার উপদেশ

তুলসী বিবাহ কাহিনী:ব্রহ্মা বলেন– শঙ্খচূড়, তুমি এই রমণীর সঙ্গে কি কথা বলছ? গান্ধর্ব বিবাহ অনুযায়ী তুমি একে বিয়ে কর। তুমি পুরুষদের মধ্যে রত্নস্বরূপ। তুলসীও স্ত্রীগণের মধ্যে রত্নস্বরূপা। বিদগ্ধ নায়কের সঙ্গে বিদগ্ধা নায়িকার মিলন অত্যন্ত আনন্দকর হয়ে থাকে। হে রাজা, এই বিবাদহীন দুর্লভ সুখ কে পরিত্যাগ করে? যে এই নির্বিকার সুখ পরিত্যাগ করে, সে যে পশুতুল্য তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সতি, তুমি দেবাসুর ও দানবদের বিমর্দনকারী।

এরকম গুণবান স্বামীকে কি পরীক্ষা করছ? যেরকম লক্ষ্মীপতির সঙ্গে লক্ষ্মী, কৃষ্ণের সঙ্গে রাধিকা, আমার সঙ্গে সাবিত্রী, শঙ্করের সঙ্গে ভবানী, বরাহের সঙ্গে ধরা, হিমালয়ের সঙ্গে মেনকা, অত্রির সঙ্গে অনুসূয়া, নলের সঙ্গে দময়ন্তী; যেরকম চন্দ্রের সঙ্গে রোহিণী, কালের সঙ্গে রতি, কশ্যপের সঙ্গে অদিতি, বশিষ্ঠের সঙ্গে অরুন্ধতী; যেরকম গৌতমের সঙ্গে অহল্যা, কর্দমের সঙ্গে বেদহূতি, বৃহস্পতির সঙ্গে তারা, মনুর সঙ্গে শতরূপা; যেরকম যজ্ঞের সঙ্গে দক্ষিণা, হুতাশনের সঙ্গে স্বাহা, ইন্দ্রের সঙ্গে শচী, গণপতির সঙ্গে পুষ্টি ও ধর্মের সঙ্গে মূর্তি প্রভৃতি সুখ মিলনে আবদ্ধা হয়ে আছেন ।

সেরকম তুমিও এই শঙ্খচূড়ের সঙ্গে মিলিতা হয়ে এর প্রিয়া ও সৌভাগ্যশালিনী হও। সুন্দরি তুমি এই সুন্দর পুরুষের সঙ্গে চিরকাল স্থানে স্থানে নিরন্তর যেমন ইচ্ছা বিহার কর। পরে শঙ্খচূড় লোকান্তরে চলে গেলে গোলোকে গোবিন্দকেই পুনরায় পাবে। এরকম আশীর্বাদ করে ব্রহ্মা নিজের মন্দিরে চলে গেলেন।

দেবী তুলসী ও শঙ্খচূড়ের বিবাহ সম্পন্ন এবং শঙ্খচূড়ের অত্যাচার

তুলসী বিবাহ কাহিনী:তখন শঙ্খচূড় তুলসীকে গান্ধবমতে বিবাহ করলেন। তাঁদের উভয়ের বিবাহের সময় স্বর্গে দুন্দুভিধ্বনি ও পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকল । শঙ্খচূড় তুলসীকে বিবাহ করে নিজ রাজ্যে ফিরে এসে রাজ্যভোগ করতে থাকেন। রাজরাজেশ্বর মহাবলশালী শঙ্খচূড় এক মন্বন্তর কাল পর্যন্ত এরকম ভাবে ত্রিভুবনের দেব, দানব, অসুর, গন্ধর্ব, কিন্নর, রাক্ষস প্রভৃতির শাসনকর্তা হয়ে রাজ্য বিস্তার করতে লাগলেন । তাতে স্বর্গবাসী দেবগণ নিজ অধিকার হারা হয়ে ভিক্ষুকের মত ঘুরে বেড়াতে থাকলেন। শঙ্খচূড় তাঁদের পূজা, হোম, বিষয়, আশ্রয়, অধিকার, অস্ত্র, ভূষণ প্রভৃতি সবকিছুই জোরপূর্বক কেড়ে নিলেন।

ব্রহ্মা এবং দেবতাগণের শ্রীহরির নিকট নিবেদন

তুলসী বিবাহ কাহিনী:অসহায় দেবতারা ছবির পুতুলের মত নিরুদ্যম হয়ে বিষণ্ণ মনে ব্রহ্মার নিকট গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব বৃত্তান্ত বললেন । ব্রহ্মা সকল কথা শুনে দেবগণকে নিয়ে শিবের নিকট গেলেন। সেখানে দেবগণ চন্দ্রশেখরকে সকল বৃত্তান্ত বর্ণনা করে বললে তিনি ও ব্রহ্মা দু’জনে দেবগণকে সঙ্গে নিয়ে সুদুর্লভ জরা মৃত্যুশূন্য পরম ধাম বৈকুণ্ঠে গিয়ে ভগবান শ্রীহরির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। বৈকুণ্ঠে জগতের বিধানকর্তা ব্রহ্মা করজোড়ে সকল বৃত্তান্ত শ্রীহরির নিকট নিবেদন করলেন।

শ্রীহরি মুখে শঙ্খচূড়ের কাহিনী বৃত্তান্ত বর্ণন

তুলসী বিবাহ কাহিনী: ব্রহ্মার কথা শুনে সর্বজ্ঞ ও সর্বভাববিৎ শ্রীহরি মধুর হাসি হেসে মধুর ভাষায় বলতে থাকেন – হে পদ্মজ, শঙ্খচূড়ের বৃত্তান্ত আমি সমুদয় অবগত আছি। সে আমার পরম ভক্ত এবং আগের জীবনে সে মহাতেজস্বী গোপ ছিল । হে দেবগণ, তোমরা সকলে সেই পুরানো ইতিহাস শোন। সে কথা পাপনাশক ও পুণ্যপ্রদ । শ্রীভগবান বলতে লাগলেন—

সেই শঙ্খচূড় পূর্বে আমার পার্ষদ-শ্রেষ্ঠ সুদামা নামে গোপ ছিল। রাধিকার দারুণ শাপে দানবকুলে সে জন্মেছে। একদিন আমি গোলোকধামে প্রাণাধিকা মানিনী রাধিকাকে ত্যাগ করে নিজ গৃহ থেকে রাসমণ্ডলে গিয়েছিলাম। পরে রাধিকা দাসীর মুখে আমাকে বিরজার সঙ্গে লীলা (ক্রীড়া) করতে শুনে সেখানে গিয়ে আমাকে দেখতে পেলেন এবং তখুনি বিরজাকে নদীরূপা এবং আমাকে তিরোহিত জেনে রাগে সখিগণের সঙ্গে পুনরায় ঘরে চলে যান।

পরে দেবী রাধিকা সেই জায়গায় মৌনভাবে ও সুস্থির অবস্থায় আমাকে সুদামার সঙ্গে অবস্থিত দেখে যথোচিত ভৎসনা করেন। সুদামা তা সহ্য করতে না পেরে তাঁর প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করলে তিনি ক্রুদ্ধা হয়ে আমার সামনেই সুদামাকে যথেষ্ট তিরস্কার করলেন। সুদামাও সেরকমই করলে রাধিকা তাঁর উপর অত্যন্ত কুপিতা হয়ে উঠলে, তাঁর দুই চক্ষু পদ্মের মত লাল হয়ে ওঠে। তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে আমার সভা থেকে সুদামাকে বের করে দিতে আদেশ করেন। আদেশ পাওয়া মাত্র দুর্বার তেজস্বিনী লক্ষ সখী উঠে বারংবার কটুভাষী সুদামাকে সভা থেকে তাড়াতাড়ি বের করে দেয়।

দেবী তুলসী বিবাহ কাহিনী তে রাধিকা সুদামাকে সন্তুষ্ট করা

তুলসী বিবাহ কাহিনী:সে সময়ে রাধিকা সুদামার কটুকথায় রেগে গিয়ে তুই দানবকূলে জন্মগ্রহণ করবি’বলে দারুণ অভিশাপ দিলেন। সুদামা ওই দারুণ অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে প্রণাম করে চলে যেতে উদ্যত হলে, রাধিকা পুনরায় সন্তুষ্টা হয়ে কৃপা করে কাঁদতে নিষেধ করে বলেন বাছা, কোথায় যাবে, যেও না, এখানেই থাক । তিনি বার বার একথা বলে সুদামার পিছনে পিছনে যেতে উদ্যতা হলেন। তখন সেখানকার গোপিগণও দুঃখ পেয়ে কাঁদতে লাগলেন।

পরে আমি রাধিকা ও তাঁদেরকে নিষেধ করলে রাধিকা সুদামাকে বললেন – সুদামা, তুমি ক্ষণাৰ্দ্ধমধ্যে আমার শাপ থেকে মুক্ত হয়ে পুনরায় এখানে চলে আসবে। কিন্তু হে বিধাতা, একথা ঠিকই যে, গোলোকের ক্ষণার্দ্ধকাল মানে পৃথিবীতে এক মন্বন্তর কাল হবে। এজন্য সেই সকল মায়াতে বিশারদ মহাবলিষ্ঠ যোগীশ্বর শঙ্খচূড় পুনরায় গোলোকধামেই যাবে।

দেবী তুলসী দেহত্যাগ

দেবী তুলসী বিবাহ কাহিনী: এখন হে সুরগণ, তোমরা আমার শূল নিয়ে তাড়াতাড়ি যাও। মহাদেব এই শূলে সেই দানবকে সংহার করবেন। সেই দানব, নিজ কণ্ঠে আমারই সর্বমঙ্গল-মঙ্গল কবচ ধারণ করে সংসারে বিজয়ী হয়েছে। সেই কবচ তার কণ্ঠে থাকতে থাকতে কেউই তাকে হিংসা করতে পারবে না। এজন্য আমিও ব্রাহ্মণরূপ ধারণ করে তা চেয়ে নেব। এবং তুমিও তা’কে বর দিয়েছ যে, যখন তার পত্নীর পতিভক্তি বিচলিত হবে, তখনই তাকে মৃত্যু অধিকার করতে পারেন। সে ব্যবস্থা আমিই করব এবং তখনই শঙ্খচূড়ের মৃত্যু হবে। পরে তার পত্নী দেহত্যাগপূর্বক আমার প্রিয়া হবে। জগন্নাথ এরকম কথা বলে মহাদেবকে শূলদান করলেন। শ্রীহরি শূলদান করে আনন্দ সহকারে নিজ পুরীতে চলে গেলে ব্রহ্মা প্রভৃতি দেবতারাও ভারতে এসে উপস্থিত হলেন ।

দেবী তুলসী বিবাহ কাহিনী সমাপ্ত

দেবী তুলসী কাহিনী অন্যান্য পোস্ট গুলো পড়ুন:-

১. তেত্রিশ কোটি দেবতা মানে।

FAQ:-তুলসী বিবাহ কাহিনী সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন উত্তর

Q:তুলসী কার স্ত্রী ছিলেন?

A: দেবী তুলসী হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী শঙ্খচূড় নামে এক অসুরের স্ত্রী ছিলেন। এই শঙ্খচূড় পূর্বে শ্রীভগবান লক্ষ্মীপতির শ্রেষ্ঠ-পার্ষদ সুদামা নামে গোপ ছিল।পুরাণে তাঁর বিবরণ নিম্নরূপ করা আছে ।


Q:তুলসী কৃষ্ণের প্রিয় কেন?

A: পুরাণ অনুসারে, তুলসী দেবী কৃষ্ণের অবতার শালগ্রামের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তুলসী দেবী শাপগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে তুলসী গাছ হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিষ্ণু তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন যে, তিনি সর্বদা তার প্রিয়তম থাকবেন এবং তুলসী গাছের পাতা তার পূজায় ব্যবহৃত হবে।

Share Please:

Leave a Comment