শিবরাত্রি হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র ব্রত। এই দিনটি ভগবান শিবের উপাসনার জন্য বিশেষভাবে পালন করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, শিবরাত্রি ব্রত পালন করলে জীবনের দুঃখ-কষ্ট দূর হয়, পাপমোচন হয় এবং আত্মা পবিত্র হয়। পুরাণে এই ব্রতের পেছনে একটি অনন্য কাহিনি রয়েছে, যা নৈতিকতা, করুণা ও সত্যের পথে চলার শিক্ষা দেয়।

শ্রাবণ মাসের শিবরাত্রি ব্রতকথা
প্রাচীন কালে চিত্রভানু নামের এক শিকারি ছিল। পশুপাখি হত্যা করেই সে তার পরিবারকে লালন পালন করত। এক সময় এক সাহুকারের কাছ থেকে ঋণ নেয়, কিন্তু ঋণ সে সময়মতো শোধ করতে না পারায়, সাহুকার রাগ করে তাকে শিবমঠে বন্দি করে রাখে। সেই দিনটি ছিল শিবরাত্রি। শিবসংক্রান্ত নানা ধর্মীয় আলোচনা চলছিল ওই মঠে, বন্দিদশায় শিকারি ধ্যানমগ্ন হয়ে শিবসম্পর্কিত নানা ধর্মীয় কথা শুনতে লাগল। চতুর্দশীর দিনে সে শিবরাত্রি ব্রতের কাহিনিও শুনে ফেলে।
সন্ধ্যা হলে সাহুকার ঋণের প্রসঙ্গে তাকে ডেকে পাঠাল। শিকারি প্রতিশ্রুতি দিল যে, পরদিনই সমস্ত ঋণ শোধ করবে। প্রতিশ্রুতির পর মুক্তি পেয়ে, প্রতিদিনের মতো সে শিকারের জন্য জঙ্গলে বেরিয়ে গেল। কিন্তু সারা দিন বন্দি থাকার কারণে অনাহারে ও তৃষ্ণায় তার শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শিকার খুঁজতে খুঁজতে সে অনেক দূর চলে যায়।
রাত হয়ে যায়, সে ভাবল, আজ তাকে বনের মধ্যেই রাত কাটাতে হবে। একটি পুকুরের ধারে একটি বেলগাছের ওপরে উঠে সে রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিল। বেলগাছের নিচে একটি শিবলিঙ্গ ছিল, যা বেলপাতায় ঢাকা ছিল—এ কথা তার জানা ছিল না। আশ্রয় নেবার সময় সে যে ডালপালা ভাঙছিল, সেগুলো কাকতালীয়ভাবে শিবলিঙ্গের ওপর পড়ে যাচ্ছিল। এতে দিনভর অনাহারে ও তৃষ্ণায় থাকার ফলে তার ব্রতও হয়ে গেল, আর শিবলিঙ্গে বেলপাতা নিবেদনও সম্পন্ন হল।
প্রথম প্রহরের ঘটনা
প্রথম প্রহর কেটে গেলে, একটি গর্ভবতী হরিণী পুকুরে জল পান এল। শিকারি ধনুকে তীর চড়াতেই হরিণী বলল—
“আমি গর্ভবতী, খুব শিগগির সন্তান প্রসব করব। তুমি একসাথে দুই প্রাণ হত্যা করবে, যা ঠিক হবে না। আমি সন্তান জন্ম দিয়ে দ্রুত তোমার কাছে ফিরে আসব, তখন তুমি আমাকে হত্যা করতে পারো।”
শিকারি করুণা করে তীর ছাড়ল না, হরিণী জঙ্গলের ঝোপে মিলিয়ে গেল। ধনুক টানার সময় কয়েকটি বেলপাতা আবারও শিবলিঙ্গের ওপর পড়ে গেল, ফলে প্রথম প্রহরের পূজাও অজান্তেই সম্পূর্ণ হয়ে গেল।
দ্বিতীয় প্রহরের ঘটনা
কিছুক্ষণ পর আরেকটি হরিণী এলো। কাছে আসতেই শিকারি তীর তুলল। হরিণী বিনীতভাবে বলল—
“আমি সদ্য ঋতুমুক্ত হয়েছি এবং আমার প্রিয় সঙ্গীর সন্ধানে বেরিয়েছি। প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হয়ে খুব শিগগিরই তোমার কাছে ফিরে আসব।”
শিকারি তাকেও ছেড়ে দিল। দু’বার শিকার হাতছাড়া হওয়ায় সে মন খারাপ করল। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরও প্রায় শেষ হতে চলল। এবারও ধনুক টানতে গিয়ে কয়েকটি বেলপাতা শিবলিঙ্গে পড়ে গেল এবং দ্বিতীয় প্রহরের পূজাও সম্পন্ন হল।
তৃতীয় প্রহরের ঘটনা
এরপর একটি হরিণী তার বাচ্চাদের নিয়ে ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিলো। শিকারি দেখেই তীর তুলতেই হরিণী বলল—
“আমাকে এই বাচ্চাগুলোকে তাদের বাবার কাছে পৌঁছে দিতে দাও, তারপর আমি আবার ফিরে আসব। এখন, দয়া করে আমাকে হত্যা করো না।”
শিকারি হাসল—”দুইবার শিকার হারিয়েছি, এখন সামনে আসা শিকার ছাড়ব না।”
হরিণী আবার বলল—”যেমন তুমি তোমার সন্তানদের ভালোবাসো, আমিও তেমনি আমার সন্তানদের ভালোবাসি। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, আমি ফিরে আসব।”
হরিণীর মায়াময় কথা শুনে শিকারির মন নরম হল, এবং সে তাকেও ছেড়ে দিল। এভাবে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর শিকারি বেলগাছে বসে বেলপাতা ছিঁড়ে ফেলছিল, যা শিবলিঙ্গের ওপর পড়ছিল।
চতুর্থ প্রহরের ঘটনা
ভোর হতেই এক বলিষ্ঠ হরিণ এল। শিকারি এবার দৃঢ় সংকল্প করল যে, এ শিকার সে নেবেই। ধনুক টানতেই হরিণ বলল—
“যদি তুমি আমার আগের তিন স্ত্রী ও তাদের সন্তানদের হত্যা করে থাকো, তবে আমাকেও হত্যা করো। কিন্তু যদি তুমি তাদের জীবন দান করে থাকো, তবে আমাকেও কিছু সময় দাও, আমি তাদের সঙ্গে দেখা করে তোমার কাছে ফিরে আসব।”
শিকারি সারা রাতের ঘটনা তাকে বলল।
হরিণ বলল—”যেমন তুমি আমার স্ত্রীদের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করেছ, তেমন আমাকেও বিশ্বাস করো।”
শিকারি তাকেও ছেড়ে দিল। এভাবে তার উপবাস, রাত্রিজাগরণ ও শিবলিঙ্গে বেলপাতা নিবেদন—সবই অজান্তে পূর্ণ হল। ফলে শিকারির হৃদয় পবিত্র হয়ে গেল, ঈশ্বরচেতনা জাগ্রত হল।
কিছুক্ষণ পর হরিণ তার পরিবারসহ ফিরে এলো যাতে শিকারি তাদের হত্যা করতে পারে। কিন্তু তাদের সততা ও পারস্পরিক ভালোবাসা দেখে শিকারির মন গলে গেল, সে তাদের জীবন দান করল।
অজান্তে পূর্ণ হল ব্রত
অজান্তেই শিবরাত্রির ব্রত পালনে শিকারি মোক্ষ লাভ করল। মৃত্যুকালে যমদূত তাকে নিতে এলে, শিবগণ এসে তাদের ফিরিয়ে দিল এবং শিকারিকে শিবলোকে নিয়ে গেল। মহাদেবের কৃপায় রাজা চিত্রভানু তার পূর্বজন্মের কথা স্মৃতিতে রাখলেন এবং পরবর্তী জন্মেও মহাশিবরাত্রির গুরুত্ব বুঝে ব্রত পালন করলেন।
কাহিনির শিক্ষা
এই কাহিনি প্রমাণ করে যে মহাদেব, অজান্তে করা ব্রতেরও ফল দেন, তবে শিকারির প্রতি মহাদেবের কৃপা, মূলত তাঁর অসীম করুণার ফলেই বর্ষিত হয়েছিল। নিজের পরিবারের কষ্ট উপেক্ষা করেও সে হরিণ পরিবারকে জীবন দান করেছিল। এ করুণা তাকে সেইসব পণ্ডিত-পূজারীর চেয়েও শ্রেষ্ঠ করেছিল, যারা কেবল উপবাস, রাত্রিজাগরণ ও বেলপাতা নিবেদন করে শিবকে সন্তুষ্ট করতে চান।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো—এই কাহিনিতে ‘অজান্তে পূজা’র গুরুত্ব দেখানো হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, শিব যেকোনোভাবে করা পূজা গ্রহণ করেন। শিকারি কোনো ফলের আশায় পূজা করেনি; সে জীব দান করেছে, যা শিবপূজার সমান। শিব শব্দের অর্থই কল্যাণ। নিরপরাধ প্রাণীদের কল্যাণ করেই সে শিবতত্ত্বকে উপলব্ধি করেছিল এবং শিবের সঙ্গে আত্মিক মিলন ঘটেছিল।
শিবরাত্রির প্রকারভেদ ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ
পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী শিবরাত্রি মূলত চার প্রকার—
১. মাসিক শিবরাত্রি – প্রতি মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয়। ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত এই রাত্রি ভক্তদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যময়।
২. প্রথমাদি শিবরাত্রি – বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান সহকারে নির্দিষ্ট দিনে পালিত হয়, যা শাস্ত্রে উল্লেখিত।
৩. মহাশিবরাত্রি – বছরে একবার, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে পালিত হয়। এটি ভগবান শিবের অন্যতম মহান ও শ্রেষ্ঠ উদযাপন।
৪. নিত্য শিবরাত্রি – প্রতিদিনের পূজা ও ধ্যানের মাধ্যমে পালন করা যায়; এটি প্রতিটি রাত্রিকেই শিবরাত্রি হিসেবে উপলব্ধির আহ্বান জানায়।
এছাড়াও কিছু বিশেষ শিবরাত্রি প্রচলিত রয়েছে—
- শ্রাবণ শিবরাত্রি – শ্রাবণ মাসে পালিত হয়; ভগবান শিবের একটি বিশেষ পূজার তিথি হিসেবে পরিচিত।
- প্রদোষ শিবরাত্রি – প্রদোষকালে (সূর্যাস্তের কিছু আগে) পালিত হয়; এই সময়টি শিবপূজার জন্য অত্যন্ত পবিত্র ধরা হয়।
আসলে, প্রতিটি রাতই ‘শিবরাত্রি’—যদি আমরা আশুতোষ ভগবানের মতো কল্যাণের পথে চলতে পারি। তবেই সেটাই শিবরাত্রির সত্য ব্রত।
শিবরাত্রি ব্রতকথা পাঠের নিয়ম
শিবরাত্রি ব্রতকথা পাঠ করার সময় কিছু নিয়ম মানা হয়—
- ব্রতের দিনে সকালে স্নান করে পরিষ্কার পোশাক পরতে হবে।
- ব্রত শুরু করার আগে ভগবান শিবের ধ্যান করতে হবে।
- বেলপাতা, ধুতুরা, আকন্দফুল ও গঙ্গাজল দিয়ে শিবলিঙ্গ পূজা করতে হয়।
- ব্রতকথা পাঠ সাধারণত সন্ধ্যা বা রাত্রিজাগরণের সময় হয়।
- গল্প পড়া বা শোনার সময় মনোযোগ ও ভক্তিভাব বজায় রাখা জরুরি।
শিবরাত্রি ব্রতকথা কথা সম্পর্কে আমার ধারণা
শিবরাত্রি ব্রতকথা শুধু একটি ধর্মীয় কাহিনি নয়, বরং মানবিকতার এক চিরন্তন শিক্ষা। গল্পের মাধ্যমে বোঝা যায়, প্রকৃত পূজা হলো করুণা, সততা ও অন্যের মঙ্গল কামনা করা। উপবাস বা রাত্রিজাগরণ যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা ও ন্যায়পরায়ণতা।
উপসংহার
শিবরাত্রি ব্রতকথা আমাদের শেখায় যে ভগবান শিব শুধু ফুল, পাতা বা উপবাসে সন্তুষ্ট হন না—তিনি সন্তুষ্ট হন যখন আমরা হৃদয়ে সৎ হই এবং জীবের কল্যাণে কাজ করি। তাই শিবরাত্রি শুধু একটি ব্রত নয়, এটি এক জীবনদর্শন, যা আমাদের মন ও সমাজকে পবিত্র করতে পারে।
মহাদেব শিব এর পূজা সম্পর্কে বিভিন্ন পোস্ট পড়ুন।
FAQ শ্রাবণ মাসের শিবরাত্রি ব্রতকথা সম্পর্কে প্রশ্নোত্তর।
প্রশ্ন ১: শিবরাত্রি ব্রত কিভাবে পালন করতে হয়?
উত্তর: শিবরাত্রি ব্রত সাধারণত উপবাস, শিবলিঙ্গে অর্ঘ্য (দুধ, জল, দই), বেলপাতা নিবেদন ও রাত্রি জাগরণ করে পালন করা হয়। ভক্তরা ধ্যান ও স্তোত্র পাঠ করেন।
প্রশ্ন ২: শিবরাত্রি ব্রতের প্রধান নিয়ম কী?
উত্তর: উপবাস, রাত্রিজাগরণ ও শিবলিঙ্গ পূজা করা প্রধান নিয়ম।
প্রশ্ন ৩: শিবরাত্রি ব্রত পালন করলে কী ফল পাওয়া যায়?
উত্তর: পাপমোচন হয়, জীবনে শান্তি আসে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটে।
প্রশ্ন ৪: ব্রতকথা কি সবাই পড়তে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, শিবভক্ত যে কেউ ব্রতকথা পড়তে বা শুনতে পারেন।