মোহিনী একাদশী মাহাত্ম্য ভূমিকা
মোহিনী একাদশী ব্রত কথা:-মোহিনী একাদশী, যা বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষে পালিত হয়, হিন্দু ধর্মে এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্রত হিসেবে জানাযায়। প্রাচীন গ্রন্থ কুর্মপুরাণে এই ব্রতের মাহাত্ম্য বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বাস করা হয়, এই ব্রত পালন করলে জীবনের সমস্ত পাপ, দুঃখ, এবং মোহজাল থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব। এই ব্রতের প্রভাবে শুধু পার্থিব জীবনেই নয়, পরলোকে গমনের পরও আত্মা উর্ধগতি তে উন্নীত হয়।
মহারাজ যুধিষ্ঠিরের জিজ্ঞাসা
কাহিনীর সূত্রপাত ঘটে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের এক প্রশ্ন থেকে। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেন, “হে জনার্দন! বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কি? এই ব্রত পালনে কি ফল লাভ হয়? এর বিধি কি? এসব সম্পর্কে আমাকে কৃপা করে বলুন।” মহারাজ যুধিষ্ঠিরের এই প্রশ্নের উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “হে ধর্মপুত্র! আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, তা একসময় শ্রীরামচন্দ্রও মহামুনি বশিষ্ঠের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন।”
শ্রীরামচন্দ্র ও বশিষ্ঠ মুনির আলোচনাঃ মোহিনী একাদশীর উদ্ভব
শ্রীরামচন্দ্র, সীতার বিরহে দুঃখিত হয়ে মহামুনি বশিষ্ঠের কাছে একটি উত্তম ব্রতের কথা যানতে চান, যা তার সমস্ত দুঃখ এবং পাপ বিনাশ করতে পারে। বশিষ্ঠ মুনি তখন তাকে বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের মোহিনী একাদশীর ব্রতের কথা বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, এই ব্রত অতুলনীয় এবং অসাধারণ পবিত্রতা ও মুক্তির প্রতীক। এই ব্রতের প্রভাবে মানুষের সমস্ত পাপ এবং দুঃখ অচিরেই বিনষ্ট হয়।
ধৃষ্টবুদ্ধির কাহিনীঃ পাপ থেকে মুক্তির দৃষ্টান্ত
মোহিনী একাদশীর মাহাত্ম্য বোঝানোর জন্য শ্রীকৃষ্ণ ধৃষ্টবুদ্ধি নামে এক পাপী যুবকের কাহিনী বর্ণনা করেন। ভদ্রাবতী নামে এক সুশোভন নগরীতে ধৃতিমান নামে এক চন্দ্রবংশীয় রাজা রাজত্ব করতেন। সেই নগরীতেই ধনপাল নামে এক পুণ্যকর্মা ও ধনবান বৈশ্য বাস করতেন। ধনপালের সুমনা, দ্যুতিমান, মেধাবী, সুকৃতি ও ধৃষ্টবুদ্ধি নামে পাঁচজন পুত্র ছিল। পঞ্চম পুত্র ধৃষ্টবুদ্ধি ছিল অত্যন্ত দুরাচারী। সে সর্বদা পরস্ত্রী সঙ্গ, বেশ্যাসক্ত, লম্পট ও দ্যুতক্রীড়া ও সুরাপান প্রভৃতি পাপাচারে লিপ্ত থাকত। তার এই সব কুস্বভাব দেখে পিতা ধনপাল তাকে গৃহ থেকে বের করে দেন।
নিজস্ব অলংকার ও সঞ্চয় এর সাহায্যে জীবন অতিবাহিত করতে লাগল। কিছু দিন যাবার পর আর্থিক কষ্টে ধৃষ্টবুদ্ধি নিজ গ্রামে চুরি করতে লাগল এবং ধরা পড়ে শাস্তি সরূপ রাজদণ্ড ভোগ করল। এবং শেষমেশ, সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে, সে বনে গিয়ে বসবাস শুরু করলো । সেখানে, সে পশুপাখি বধ করে তাদের মাংস ভক্ষণ করে দুঃখময় জীবন কাটাতে থাকে।
ঋষি কৌণ্ডিন্যর আশ্রমে ধৃষ্টবুদ্ধির পুনর্জন্ম
হঠাৎ একদিন বনে ভ্রমণ করতে করতে ধৃষ্টবুদ্ধি কৌণ্ডিন্য ঋষির আশ্রমে পৌঁছায়। বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষে ঋষি গঙ্গাস্নান করে ফিরে আসছিলেন এবং ঋষির বস্ত্র হতে একবিন্দু জল ধৃষ্টবুদ্ধির গায়ে পড়ে। এই জলস্পর্শের প্রভাবে ধৃষ্টবুদ্ধির সমস্ত পাপ ধুয়ে যায় এবং তার শুভবুদ্ধির উদয় হয়।
ধৃষ্টবুদ্ধি কৃতাঞ্জলিপুটে ঋষির কাছে প্রার্থনা করে, “হে ঋষিশ্রেষ্ঠ! আমি কোন পুণ্য প্রভাবে এই ভীষণ দুঃখ এবং পাপযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারি, তা আমাকে বলুন।” ঋষি কৌণ্ডিন্য তাকে মোহিনী একাদশী ব্রত কথা পালনের উপদেশ দেন।
মোহিনী একাদশীর ব্রত এবং ধৃষ্টবুদ্ধির মুক্তি
হে মহারাজ রামচন্দ্র! কৌণ্ডিন্য ঋষির উপদেশ মেনে ধৃষ্টবুদ্ধি মোহিনী একাদশী ব্রত কথা পালন করে নিষ্পাপ হল। এই ব্রতের প্রভাবে তার সমস্ত পাপ ধ্বংস হয়ে সে দিব্যদেহ লাভ করল। এবং শেষে, সে গরুড়ে আরোহন করে বৈকুণ্ঠধামে গমন করল।
মোহিনী একাদশীর অনন্যতা
শ্রীকৃষ্ণ মোহিনী একাদশী ব্রত কথার অমোঘ ফলাফল বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “হে রাজন! ত্রিলোকে মোহিনী ব্রত থেকে শ্রেষ্ঠ ব্রত আর কিছু নেই। যজ্ঞ, তীর্থস্থান, দান ইত্যাদি কোন পুণ্যকর্মই এই ব্রতের সমান নয়। এই ব্রতের কথা শ্রবণ ও কীর্তনে সহস্র গোদানের ফল লাভ হয়।”
মোহিনী একাদশীর উপসংহার
মোহিনী একাদশী ব্রত কথা শুধুমাত্র একটি ব্রত নয়, এটি আত্মশুদ্ধির একটি মহান পথ। বৈশাখ মাসের এই পবিত্র একাদশী পালনে জীবনের সমস্ত পাপ ও দুঃখ বিনাশ হয় এবং আত্মা পবিত্রতায় উন্নীত হয়। যারা এই ব্রত পালন করেন, তাদের জীবন আনন্দ এবং শান্তিতে ভরে ওঠে। মোহিনী একাদশীর গুরুত্ব এবং এর প্রভাব হিন্দু সনাতন ধর্মে অনন্য এবং অসাধারণ। সকলের উচিত এই পবিত্র ব্রত পালন করা এবং তার অমোঘ ফলাফল লাভ করা।
আমাদের অন্য পোস্ট গুলি দেখার জন্য নিচে ক্লিক করুন।
২.সন্ধ্যা প্রদীপ দেওয়ার নিয়ম।
FAQ:মোহিনী একাদশী ব্রত কথা সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন।
প্রশ্ন:-মোহিনী একাদশী মাহাত্ম্য কি? এবং এর মাহাত্ম্য কী?
উত্তর:-মোহিনী একাদশী হলো বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি। এই ব্রতের মাহাত্ম্য কুর্মপুরাণে বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বাস করা হয়, এই ব্রত পালন করলে জীবনের সমস্ত পাপ, দুঃখ, এবং মোহজাল থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব।
প্রশ্ন:-মোহিনী একাদশী পালন করলে কী ফল লাভ হয়?
উত্তর:-মোহিনী একাদশীর ব্রত পালনে সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয় এবং জীবনের সব দুঃখ ও মোহজাল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এটি আত্মাকে পবিত্র করে এবং ভক্তদের বৈকুণ্ঠধামে গমনের পথ প্রশস্ত করে।
প্রশ্ন:-মোহিনী একাদশী ব্রত পালনের পদ্ধতি কী?
উত্তর:-মোহিনী একাদশীর দিন উপবাস পালন করা হয়। ভক্তরা সারাদিন নিরামিষ আহার গ্রহণ করে এবং ভগবান বিষ্ণুর পূজা ও প্রার্থনা করে। বিশেষ মন্ত্রোচ্চারণ ও ভক্তিগীতির মাধ্যমে এই ব্রত পালন করা হয়।
প্রশ্ন:-মোহিনী একাদশীর ব্রত কেন পালন করা উচিত?
উত্তর:-এই ব্রত পালন করলে জীবনের সমস্ত পাপ ও দুঃখ বিনষ্ট হয় এবং ভক্তরা পবিত্র আত্মা লাভ করেন। এটি আত্মশুদ্ধির একটি মহৎ পথ এবং জীবনের নানা কষ্ট ও মোহ থেকে মুক্তির উপায়।
প্রশ্ন:-মোহিনী একাদশী ব্রত সম্পর্কে কোন পুরাণে উল্লেখ রয়েছে?
উত্তর:-মোহিনী একাদশীর মাহাত্ম্য কুর্মপুরাণে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও, শ্রীকৃষ্ণ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সামনে এই ব্রতের গুরুত্ব ও ফলাফল সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন।