
শ্রীমদ্ভগবদগীতা পাঠের নিয়ম
গীতা পাঠের সঠিক নিয়ম:-মানুষ ভগবানের সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব। মানবজীবনের একটি মহৎ উদ্দেশ্য ও কর্তব্য রয়েছে, যা হচ্ছে ব্রহ্মজিজ্ঞাসা— “আমি কে?”, “আমি কোথা থেকে এলাম?”, “আমি কেন এখানে এত কষ্ট ভোগ করছি?”। যতক্ষণ না এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষ হতে পারে না। মানবজীবন সুদুর্লভ ও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তাই, এই জীবনের যথার্থ ব্যবহার না করলে এটি বৃথা অপচয় করা হবে। ব্রহ্মজিজ্ঞাসার উত্তর পেতে সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদগীতা অধ্যয়ন করা কর্তব্য।
গীতা পাঠের প্রয়োজনীয়তা
শ্রীমদ্ভগবদগীতা আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক। সয়ং পরমঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ নিজেই এর মাধ্যমে জীবনের সঠিক দর্শন ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু অনেকেই গীতা পাঠের সঠিক নিয়ম না জানার কারণে দ্বিধাগ্রস্ত হন। কেউ কেউ মনে করেন, সংস্কৃত শ্লোক বুঝতে না পারলে গীতা পাঠ করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গীতা পাঠের নির্দিষ্ট কঠোর নিয়ম নেই। যেকোনো মানুষ ভগবানের প্রতি ভক্তি রেখে গীতা পাঠ শুরু করতে পারেন। এটি এক জ্ঞানের সাগর, যা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে।
গীতা পাঠ শুরুর পূর্বে করণীয়
গীতা পাঠ পূর্বে শুদ্ধভাবে পূর্ব বা উত্তরমুখে বসিয়া আচমন, বিষ্ণুস্মরণ, স্বস্তিবাচন, সঙ্কল্প ও আসনাদি শুদ্ধির পর নিম্নোক্ত মন্ত্র পাঠে করন্যাস করিবেন। মন্ত্র যথাঃ – ওঁ অস্য শ্রীমদ্ভগবদ্গীতামালা – মন্ত্রস্য শ্রীভগবান্ ছন্দঃ শ্রীকৃষ্ণঃ পরমাত্মা দেবতা বেদব্যাসঋষিরনুষ্টুপ্ “অশোচ্যানন্বশোচস্তং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে” ইতি বীজম। “সবধর্ম্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণংব্রজ” ইতি শক্তিঃ । “অহং ত্বাং সর্ব্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ” ইতি কীলকম।
- এই মন্ত্রটি পাঠ করিয়া উভয় হস্তের তর্জ্জনী দ্বারা অঙ্গুষ্ঠ স্পর্শ করিয়া “নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ” ইতি অঙ্গুষ্ঠাভ্যাং নমঃ।
- এই মন্ত্র পড়িয়া পুনরায় ঐরূপে অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা তজ্জনী স্পর্শ করতঃ-“ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপ্যো ন শোষয়তি মারুতঃ” ইতি তজ্জনীভ্যাং স্বাহা। “অচ্ছেদ্যোঽয়মদাহ্যো হয় মক্লেদ্যোহ শোষ্য এব চ” ইতি মধ্যমাভ্যাং বষট।
- এই মন্ত্রটি পাঠ করিয়া অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা অনামিকা স্পর্শ করতঃ- “নিত্যঃ সর্ব্বগতঃ স্থাণুরচলোঽয়ং সনাতনঃ” ইতি অনামিকাভ্যাং হুং।
- এই মন্ত্রটি পাঠ করিয়া অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা কনিষ্ঠা স্পর্শ করতঃ- “পশ্য মে পার্থ রূপাণি শতশোহথ সহস্রশঃ” ইতি কনিষ্ঠাভ্যাং বৌষট।
- এই মন্ত্রটি পাঠ করিয়া দক্ষিণ হস্তের করতল দ্বারা বামহস্তের করতলকে বেষ্টন করিতে করিতে— “নানাবিধানি দিব্যানি নানাবর্ণাকৃতীনি চ” ইতি করতলপৃষ্ঠাভ্যাং অস্ত্রায় ফট। এই মন্ত্রটি পাঠ করিবেন ও বাম করতলের উপর দক্ষিণ করতল দ্বারা হাততালি দিতে হইবে। ইতি করন্যাসঃ।
- অতঃপর অঙ্গন্যাস করিবেন। মন্ত্র যথাঃ “নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ” ইতি হৃদয়ায় নমঃ। এই মন্ত্রটি পাঠ করিয়া দক্ষিণ হস্ত দ্বারা হৃদয় স্পর্শ করতঃ-
- “ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ” ইতি শিরসে স্বাহা। এই মন্ত্রটি পাঠ করিয়া মস্তক স্পর্শ করিবেন,
- তৎপরে—“অচ্ছেদ্যোঽয়মদাহ্যোঽয়মক্লেদ্যোঽ শোষ্য এব চ” ইতি শিখায়ৈ বর্ষট। এই মন্ত্রটি পাঠ করিয়া শিখা স্পর্শ করিবেন,
- তৎপরে—“নিত্যঃ সর্ব্বগতঃ স্থাণুরচলোঽয়ং সনাতনঃ” ইতি কবচায় হুং। এই মন্ত্রটি পাঠ করিয়া কবচ স্পর্শ করিবেন,
- তৎপরে—“পশ্য মে পার্থরূপাণি শতশোহথ সহস্রশঃ” ইতি নেত্রত্রয়ায় বৌষট।, এই মন্ত্রটি পাঠ করিয়া নেত্রদ্বয় ও ভ্রমধ্য স্পর্শ করিবার পর
- “নানাবিধানি দিব্যানি নানাবর্ণাকৃতীনি চ” ইতি অস্ত্রায় ফট্। এই মন্ত্রটি পাঠ করিয়া হাততালি দিবেন। ইহার নাম অঙ্গন্যাস।
- তারপর গণেশাদি পঞ্চদেবতা এবং শ্রীকৃষ্ণের পূজা করিয়া মঙ্গলাচরণের শ্লোকগুলি পাঠ করতঃ গীতা পাঠ করিবেন।
বিদ্র:- যদি উপরের নিয়মটি পালন না করতে না পারেন তাহলে নিচে দেওয়া নিয়ম টি পালন করবেন।
গীতা পাঠের সঠিক নিয়ম
সূচী শুদ্ধ হয়ে পবিত্র বস্ত্র পরিধান করে পবিত্র স্থানে আসন পেতে উত্তর বা পূর্ব দিকে মুখ করে বসবেন, এরপর আচমন ও বিষ্ণুস্মরণ, করার পর পাঠ শুরু করুন।
- প্রথমে হাত জোড় করে “ওঁ তৎ সৎ” মন্ত্রটি বলুন।
- এরপর শ্রীগুরুদেব প্রণাম মন্ত্র:“ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া, চক্ষুরুন্মিলতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।
- সরস্বতী-ব্যাসাদি প্রণাম মন্ত্র: নারায়ণং নমস্কৃত্য নরন্চৈব নরোত্তমম্। দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততোজয়মুদিরয়েৎ।।
- শ্রীকৃষ্ণ প্রণাম মন্ত্র:হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে। গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে।। নম ব্রহ্মণ্য দেবায় গো ব্রহ্মণ্য হিতায় চ। জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় বাসুদেবায় নমঃ নমঃ।।
- রাধারানী প্রণাম মন্ত্র:তপ্তকাঞ্চনগৌরাঙ্গী রাধে বৃন্দাবনেশ্বরি বৃষভানুসুতে দেবী প্রণমামি হরিপ্রিয়ে।
- বৈষ্ণব প্রণাম মন্ত্র:বাঞ্ছাকল্পতরুভ্যশ্চ কৃপাসিন্ধুভ্য এব চ। পতিতানাং পাবনেভো বৈষ্ণবেভো নমো নমঃ।
গীতা পাঠের ধাপ:
- অধ্যায় ঘোষণা করা: পাঠ শুরুর আগে অধ্যায়ের নাম ও যে কয়টি শ্লোক পাঠ করবেন সেগুলি উল্লেখ করবেন। উদাহরণ: “অথ শ্রীমদ্ভগবদগীতা চতুর্থ অধ্যায়, জ্ঞানযোগ অষ্টাত্রিংশ শ্লোক হইতে দ্বিচত্বারিংশ শ্লোক পর্যন্ত।”
- শ্লোক পাঠ করা: “শ্রীভগবান উবাচ: ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে। তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি।।”
- অনুবাদ পাঠ করা: শ্লোকের বাংলা অনুবাদ বলুন। “জ্ঞানের ন্যায় পবিত্র ইহলোকে আর কিছুই নাই। জ্ঞানযোগে সিদ্ধ যোগী অন্তকালে পরমাত্মায় লীন হন।”
- অর্থ ও ব্যাখ্যা: পাঠ শেষে শ্লোকের গভীর ব্যাখ্যা বোঝার চেষ্টা করুন এবং এটি জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করা যায় তা ভাবুন।
শ্রীমদ্ভগবদগীতা পাঠ করার শেষের নিয়ম
- শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ১৮টি পবিত্র নামসমূহ পাঠ করুন:ওঁ গঙ্গা, গীতা চ, সাবিত্রী, সীতা, সত্যা, পতিব্রতা, পতিব্রতা, ব্রহ্মাবলী, ব্রহ্মবিদ্যা, ত্রিসন্ধ্যা, মুক্তিগেহিনী, প্রত্যক্ষা ব্রহ্ম, তত্ত্বার্ণব, ত্রয়ীসার, গায়ত্রী, সর্বশাস্ত্রময়ী, শাস্ত্রসংঘাতি, তত্ত্বময়ী, অমৃতসংজ্ঞানী
- পঞ্চতত্ব এবং হরে কৃষ্ণ মহা মন্ত্র পাঠ করুন:শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌরভক্তবৃন্দ।। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
- ক্ষমাভিক্ষার মন্ত্র বলুন: “যদ অক্ষরং পরিভ্রষ্টং মাত্রাহীনঞ্চ যদ ভবেৎ। পূর্ণং ভবতু তৎ সর্বং তৎপ্রসাদাৎ জনার্দনঃ।”
- শান্তি মন্ত্রে পাঠ শেষ করুন:”ওঁ সর্বে সুখিনঃ ভবন্তু, সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ। সর্বে ভদ্রাণী পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ্ দুঃখ ভাগ ভবেত।।”
গীতা পাঠের সময় কিছু বিষয় মনে রাখা উচিত
- শুদ্ধ উচ্চারণে শ্লোক পাঠের চেষ্টা করুন, তবে আন্তরিকতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
- প্রতিদিন একটি অধ্যায় পড়ার চেষ্টা করুন। সম্ভব না হলে কয়েকটি শ্লোক পড়লেও যথেষ্ট।
- মনকে শান্ত রেখে সম্পূর্ণ মনোযোগ সহকারে পাঠ করুন।
- গীতার পাঠ শুধুমাত্র পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে, এর দর্শন জীবনে প্রয়োগ করুন।
- গীতার গভীর অর্থ বুঝতে কোনো গুরু বা অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
- নিয়মিত পাঠ করলে জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে এবং মানসিক শান্তি বৃদ্ধি পায়।
শ্রীমদ্ভগবদগীতা পাঠের উপকারিতা
গীতা পাঠ করলে মানসিক প্রশান্তি আসে এবং জীবনের জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান পাওয়া যায়। এটি আমাদের আত্ম-উন্নতি ও মনোবল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। গীতার শিক্ষাগুলো দৈনন্দিন জীবনে অনুসরণ করলে মানুষের আচার-আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। এটি কেবল ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, বরং একটি জীবন দর্শন যা সত্য, ন্যায়, ধর্ম এবং কর্মের সঠিক পথ দেখায়।
উপসংহার
গীতা পাঠ শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি জীবনের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করার এক অনন্য পথ। ভগবানের প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তি নিয়ে গীতা পাঠ করলে তা মানুষের জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। কঠোর নিয়ম বা আচার পালনের চেয়ে আন্তরিকতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই মন থেকে ভক্তি সহকারে গীতা পাঠ করুন এবং জীবনের মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করুন। গীতা আমাদের আত্মজ্ঞান ও নৈতিকতার পথ দেখায়, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
দৈনিন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় কিছু পোস্ট
*অঙ্গে মাখো মাখো রে এই না ব্রজের ধুলা
গীতা পাঠের নিয়ম নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন: গীতা পাঠ কিভাবে শুরু করতে হয়?
উত্তর: গীতা পাঠ শুরু করার আগে শুদ্ধভাবে পূর্ব বা উত্তরমুখে বসে পবিত্র বস্ত্র পরিধান করা উচিত। এরপর আচমন, বিষ্ণুস্মরণ, এবং গুরু ও দেবতাদের প্রণাম করে “ওঁ তৎ সৎ” মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। তারপর শ্রীগুরু, সরস্বতী, শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানীকে প্রণাম করে পাঠ শুরু করা যায়।
প্রশ্ন:গীতা পাঠ কখন এবং কীভাবে শুরু করা উচিত?
উত্তর: গীতা পাঠ শুদ্ধ মন নিয়ে, পবিত্র বস্র পরিধান করে এবং পূর্ব বা উত্তরমুখে বসে শুরু করা উচিত। প্রথমে গুরু ও দেবতাদের স্মরণ করে “ওঁ তৎ সৎ” মন্ত্র পাঠ করে গীতা অধ্যয়ন শুরু করা যায়।
প্রশ্ন: গীতা পাঠের জন্য কি সংস্কৃত জানা আবশ্যক?
উত্তর: না, গীতা পাঠের জন্য সংস্কৃত জানা বাধ্যতামূলক নয়। মূল সংস্কৃত শ্লোকের সাথে তার অনুবাদ ও ব্যাখ্যা পড়লে সহজেই এর অর্থ বোঝা যায়। বাংলা বা অন্য ভাষায় গীতার অনুবাদ পড়লেও সমান উপকার পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: প্রতিদিন গীতা পাঠ করলে কী উপকার হয়?
উত্তর: গীতা পাঠ করলে মানসিক শান্তি, আত্মবিশ্বাস ও ধৈর্য বৃদ্ধি পায়। এটি আমাদের নৈতিকতা ও কর্মফল সম্পর্কে শিক্ষা দেয় এবং জীবনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন: গীতা পাঠের সময় কোনো বিশেষ বিধি আছে কি?
উত্তর: গীতা পাঠের জন্য কঠোর বিধি নেই, তবে শুদ্ধতা ও আন্তরিকতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চারণ শুদ্ধ হলে ভালো, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গীতার শিক্ষাগুলোকে হৃদয়ঙ্গম করা ও জীবনে প্রয়োগ করা।