
ছোটদের রামায়ণ কথা উত্তরা কাণ্ড
ছোটদের রামায়ণ কথা: রামায়ণ এক মহান পুরাণ, যেখানে ধর্ম, ন্যায় ও আত্মত্যাগের আদর্শ ফুটে উঠেছে। এই মহাকাব্যের অন্তিম পর্ব, উত্তরা কাণ্ড, শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যশাসন এবং সীতা দেবীর কঠিন পরীক্ষা নিয়ে গঠিত। প্রজাদের কল্যাণের জন্য রাজা রামচন্দ্র এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেন—গর্ভবতী সীতা দেবীকে বনবাসে পাঠান। ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে জন্ম নেয় লব ও কুশ, যারা ভবিষ্যতে নিজেদের অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দেয়। এই অংশে আমরা দেখব, কীভাবে তাদের সঙ্গে শ্রীরামের পুনর্মিলন ঘটে, কীভাবে অশ্বমেধ যজ্ঞ এক অনন্য মোড় নেয়, এবং শেষ পর্যন্ত কীভাবে সীতা দেবী ধরণীর কোলে আশ্রয় নেন।
সীতার বনবাস
অযোধ্যার রাজা শ্রীরামচন্দ্রের অভিষেক শুভদিনে সম্পন্ন হলো। তাঁর পাশে ছিলেন রাজরানি সীতা, আর যুবরাজ হিসেবে দায়িত্ব পেলেন ভরত। রামের রাজত্বে প্রজারা শান্তি ও সুখে দিন কাটাচ্ছিল।
কিন্তু একদিন মহারাজের কানে এল, কিছু প্রজা গোপনে সীতা দেবীর সমালোচনা করছে। কারণ, তিনি কখনো রাক্ষসরাজ রাবণের লঙ্কায় বন্দি ছিলেন। এ সংবাদ গুপ্তচরের মাধ্যমে শুনে রাম গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। প্রজাদের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা এতটাই প্রবল ছিল যে, জনমতের শান্তির জন্য তিনি সীতা দেবীকে গর্ভবতী অবস্থায় বনবাসে পাঠানোর কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন।
লক্ষ্মণ সীতাকে তমসা নদীর ওপারে ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে রেখে এলেন। সেখানেই সীতা দেবী যমজ পুত্র জন্ম দিলেন, যাদের নাম বাল্মীকিই রাখলেন—লব ও কুশ। বাল্মীকি তাদের সকল বিদ্যায় পারদর্শী করে তুললেন এবং শিখালেন রামায়ণ গান, যা ভবিষ্যতে ইতিহাস হয়ে উঠল।

ছোটদের রামায়ণ কথা লব-কুশ ও অশ্বমেধ যজ্ঞ
সীতাকে বনবাসে পাঠানোর পর শ্রীরামচন্দ্রের মনে শান্তি ছিল না। তিনি একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন। এই যজ্ঞের জন্য প্রয়োজন একটি সর্বগুণসম্পন্ন অশ্ব নির্বাচন করাহল। সেই অশ্বকে সযত্নে সাজিয়ে, ললাটে জয়পত্র বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হল। বিশাল সৈন্যবাহিনীসহ শত্রুঘ্ন যাত্রা করলেন অশ্বের পিছু পিছু। যে রাজ্য বশ্যতা স্বীকার করবে, সেখানে যুদ্ধ হবে না; কিন্তু যেখানে বাধা আসবে, সেখানেই রণক্ষেত্র গড়ে উঠবে। এভাবেই একের পর এক দেশ জয় করে যখন অশ্ব ফিরে আসবে, তখনই হবে যজ্ঞ।
অথচ, পথে কোথাও কেউ সেই অশ্বকে আটকানোর সাহস করল না—আটকানোর এল বাল্মীকির আশ্রম থেকে। সেখানে দুই বালক, লব ও কুশ, অশ্বটিকে আটকাল। শত্রুঘ্ন অনেক বুঝিয়েও ব্যর্থ হলেন, কারণ লব-কুশ অশ্ব ছাড়তে রাজি হল না। ফলস্বরূপ, শুরু হল ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, সেই যুদ্ধে শত্রুঘ্ন ও তার সেনাবাহিনী পরাজিত হল এবং নিহত হলেন শত্রুঘ্ন নিজেও।
সংবাদ পৌঁছাল অযোধ্যায়। রাম তখনই ভরত ও লক্ষ্মণকে পাঠালেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, লব-কুশের কাছে তাঁরাও যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলেন। শেষ পর্যন্ত স্বয়ং শ্রীরাম যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। কিন্তু তিনিও দুই বালকের হাতে পরাজিত হয়ে অজ্ঞান হয়ে ভূমিতে পড়ে রইলেন।
বিজয়ী লব-কুশ তখন আশ্রমে ফিরে গেল। যুদ্ধের ঘটনার কথা শুনে সীতা মুহূর্তেই বুঝতে পারলেন, কারা নিহত হয়েছে! ব্যথায়, শোকে, কষ্টে তিনি বিলাপ করতে লাগলেন। কিন্তু তখন আশ্রমে মহর্ষি বাল্মীকি উপস্থিত ছিলেন না; তিনি চিত্রকূট পর্বতে তপস্যায় ছিলেন। সদ্য ফিরে এসে সীতার কান্নার কারণ জানতে পেরে তিনি দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রে গেলেন। ঋষির মৃত্যুজীবী জলের স্পর্শে রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্নসহ সকল নিহত ব্যক্তি পুনরুজ্জীবিত হলেন।
শ্রীরামের সঙ্গে লব-কুশের মিলন
এরপর অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব ফিরিয়ে দেওয়া হল। বাল্মীকি এবং লব-কুশ যজ্ঞে আমন্ত্রিত হলেন। একদিন যজ্ঞ সম্পন্ন হল, এবং সেই যজ্ঞমঞ্চেই শুরু হল মহাকাব্য রামায়ণ-গান। এক মাস ধরে বীণার সুরে লব ও কুশ রামায়ণের কাহিনি গাইল। শ্রোতারা মোহিত হয়ে শুনল সেই গান।
শেষ পর্যন্ত রামের সমস্ত সন্দেহ দূর হল। তিনি উপলব্ধি করলেন, এই দুই বালক আর কেউ নয়—তাঁরই রক্ত, তাঁরই সন্তান! পিতার হৃদয়ে আবেগ উচ্ছ্বসিত হল। স্নেহে, ভালোবাসায়, আনন্দে তিনি লব-কুশকে বুকে টেনে নিলেন।

বসুমাতার কোলে সীতার পাতাল প্রবেশ
বাল্মীকি সীতাকে তপোবন থেকে রাজসভায় নিয়ে এলেন। সেখানে আবারও সীতার নির্দোষিতার প্রশ্ন উঠল। সত্যের প্রমাণ দিতে তাঁকে আবার অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হল। সীতা সেই কঠিন পরীক্ষায় প্রমাণ করলেন, তিনি সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক ও সতী।
তবে কি ভবিষ্যতে আবার তাঁকে এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে? কত দুঃখ, কত অপমান সইতে হবে তাঁকে? জন্মের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় কি হবে তার সব দুঃখ, অপমানের অবসান? মাটির কোলে জন্ম নেওয়া সীতা এবার মাটির কাছেই ফিরে যেতে চাইলেন। তিনি আকুল প্রার্থনা করলেন, “মা বসুমতী, তুমি তোমার কোলে ফিরিয়ে নাও।”
রাজসভার সকলের সামনে ঘটে গেল এক অলৌকিক দৃশ্য—ভূমি দ্বিখণ্ডিত হলো, আর সীতা ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই মাটির গভীরে। মুহূর্তের মধ্যেই তিনি অন্তর্ধান করলেন, যেন অভিমানী সীতা এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন চিরতরে। পরে তিনি লক্ষ্মীদেবীরূপে স্বর্গে ফিরে গেলেন।
এ দৃশ্য দেখে শোকের সাগরে ভেসে গেলেন রাম, লব-কুশ ও রাজসভায় উপস্থিত সকলে।
রামের লক্ষ্মণ বর্জন ও অমৃতলোকে যাত্রা
একদিন যম সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে শ্রীরামের দরবারে উপস্থিত হলেন। তিনি শ্রীরামের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাইলেন এবং শর্ত রাখলেন যে, এই আলোচনার সময় কেউ যদি কক্ষে প্রবেশ করে, তবে দ্বাররক্ষীকে বর্জন করতে হবে। শ্রীরাম লক্ষ্মণকে দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব দিলেন এবং যমের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন।
ঠিক সেই সময় সেখানে এলেন দুর্বাসা মুনি, যিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্রোধী এবং অল্প কারণেই অভিশাপ দানে সক্ষম। তিনি রামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান এবং লক্ষ্মণকে দ্রুত পথ ছাড়তে বললেন। লক্ষ্মণ জানতেন, দুর্বাসাকে অসন্তুষ্ট করলে ভয়ানক অভিশাপ আসতে পারে। তাই তিনি সংকটের আশঙ্কায় কক্ষরক্ষা ভঙ্গ করে দুর্বাসাকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন।
এর ফলে শর্ত অনুযায়ী লক্ষ্মণকে বর্জন করতে হলো। এই কঠিন সিদ্ধান্ত মেনে তিনি খরস্রোতা সরযু নদীতে নেমে আত্মবলিদান করলেন।
লক্ষ্মণের প্রয়াণে শ্রীরামের মনে আর জীবনের প্রতি আকর্ষণ রইল না। তিনি লব ও কুশকে যথাক্রমে অযোধ্যা ও নন্দীগ্রামের রাজ্যভার অর্পণ করলেন। তারপর অমৃতলোকের পথে যাত্রা করলেন।
শুধু শ্রীরাম নন, তাঁর অনুগামী হলেন ভরত, শত্রুঘ্ন এবং অগণিত নর, বানর ও রাক্ষস—সকলেই সরযু নদীতে প্রবেশ করে ভবলীলা সমাপ্ত করলেন। তবে হনুমান, জাম্বুবান এবং বিভীষণ, যাঁরা অমরত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তাঁরা পৃথিবীতেই রয়ে গেলেন।
ছোটদের রামায়ণ কথা উত্তরা কাণ্ড সমাপ্ত
সংক্ষেপে রামায়ণের আরো কিছু পর্ব
*ছোটদের রামায়ণ লঙ্কা কাণ্ড এক ঐতিহাসিক অধ্যায় ।
*ছোটদের রামায়ণ সংক্ষিপ্ত কাহিনী আদিকাণ্ড ।