
ছোটদের রামায়ণ আদিকাণ্ড
ছোটদের রামায়ণ কাহিনী: রামায়ণ হল প্রাচীন ভারতের অন্যতম মহাকাব্য, যা রাজা শ্রীরামচন্দ্র ও তাঁর পত্নী সীতা দেবীর জীবনকথা তুলে ধরে বর্ণনা হয়েছে। মহর্ষি বাল্মীকি রচিত এই মহাকাব্য শুধু কাহিনির দিক থেকেই নয়, নৈতিক শিক্ষার দিক থেকেও অত্যন্ত মূল্যবান। রামায়ণের প্রতিটি অধ্যায় ন্যায়, ধর্ম ও কর্তব্যবোধের বার্তা বহন করে। ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় রামায়ণের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো, যাতে তারা এই মহান কাহিনির শিক্ষা ও মূল্যবোধ গ্রহণ করতে পারে।
অযোধ্যার রাজা দশরথ ও এক মহাশোকের সূচনা
সে অনেক কাল আগের কথা। সরযূ নদীর তীরে অবস্থিত কোশল রাজ্যের রাজধানী ছিল অযোধ্যা। এক সময় এই নগরী ছিল রঘুবংশের গৌরবময় রাজাদের শাসনাধীনে। রাজা রঘু ও তাঁর পুত্র অজ পরম প্রতাপশালী শাসক ছিলেন। তাঁদের উত্তরসূরি, অজ-র পুত্র দশরথ, তখন অযোধ্যার রাজাসনে আসীন। পিতামহ ও পিতার মতো তিনিও ছিলেন বীর ও সুশাসক।
রাজা দশরথের রাজত্বকালে অযোধ্যা নগরীর অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। এক সুদৃশ্য এ নগরী ছিল অপরূপ সৌন্দর্যের আধার। প্রশস্ত রাজপথের পাশে সারি সারি সুদৃশ্য অট্টালিকা ছিল। রাজপ্রাসাদ ছিল মহিমাময় ও জাঁকজমকপূর্ণ। রাজা দশরথ ছিলেন সর্বগুণে গুণান্বিত, কারণ বশিষ্ঠ মুনির কাছে তিনি নানা শাস্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, আর ভৃগুমুনির কাছ থেকে শিখেছিলেন শব্দভেদী বাণ চালানোর কৌশল।
কিন্তু এত ঐশ্বর্য, প্রজা-প্রসাদ, ও রাজকীয় গৌরব সত্ত্বেও রাজা দশরথের মন ছিল অশান্ত। কারণ তাঁর তিন রানি—কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা— কেউই সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি । তাই তিনি দুঃখে চিন্তায় ডুবে থাকতে আর ভাবতেন— ভবিষ্যতে কে হবে অযোধ্যার রাজা?
এই দুঃখবোধ নিয়ে একদিন রাজা দশরথ শিকারে বের হন। শিকারের মাঝে তিনি এক অরণ্যে প্রবেশ করেন, যেখানে এক মুনি ও তাঁর স্ত্রী বসবাস করতেন, ওনারা দুজনেই ছিলেন দৃষ্টিহীন । তাঁদের একমাত্র পুত্র, সিন্ধুমুনি, দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন ছিলেন এবং তাঁর পিতা-মাতার সেবায় সর্বদা নিয়োজিত থাকতেন।
এক সময় পিতামাতার সেবার জন্য সিন্ধুমুনি নদীতে জল আনতে গিয়েছিলেন। যখন তিনি কলসিতে জল ভরছিলেন, তখন জল ভরতে ভরতে এক শব্দের সৃষ্টি হয়। রাজা দশরথ দূর থেকে সে শব্দকে হরিণের জলপানের শব্দ ভেবে ভুলবশত শব্দভেদী বাণ ছুঁড়ে দেন। সেই বাণ সরাসরি এসে বিদ্ধ করে সিন্ধুমুনিকে, এবং মুহূর্তেই তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে যায়।
পুত্রের আকস্মিক মৃত্যুতে শোকে মোহাচ্ছন্ন হয়ে অন্ধ মুনি রাজা দশরথকে এক ভয়ংকর অভিশাপ দেন—“যেমন আমি পুত্রশোকে কাতর হয়ে পড়েছি, তেমনই তুমিও একদিন পুত্রশোকে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে।”
রাজা দশরথ তখন বললেন, “কিন্তু আমার তো কোনো পুত্রই নেই! আমি কীভাবে পুত্রশোকে মরব?” তখন অন্ধ মুনি ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, “আমার বাক্য মিথ্যা হবে না। তুমি পুত্রশোকে কাতর হয়ে মারা যাবে। তবে তার আগে তোমার পুত্র জন্ম নেবে। পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করো। যজ্ঞের প্রসাদ হিসেবে, এই বেল ফল রানিদের খাওয়ালে, তারা তোমাকে নারায়ণরূপী পুত্র প্রদান করবেন।”
এ কথা শুনে নিঃসন্তান রাজা দশরথ গভীরভাবে চিন্তায় পড়লেন। অন্ধ মুনির অভিশাপ যেন তাঁর ভবিষ্যৎ ভাগ্যের এক পূর্বাভাস হয়ে উঠল…

ছোটদের রামায়ণ কাহিনী:-দশরথের পুত্র লাভের জন্য পুত্রেষ্টি যজ্ঞ ও সীতার জন্মকাহিনী
শিকার থেকে অযোধ্যায় ফিরে, রাজা দশরথ পুত্রলাভের জন্য সরযু নদীর তীরে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ শুরু করলেন। তিনি দেশের সব মুনি-ঋষি এবং রাজা-মহারাজাকে যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করলেন। এক বছর ধরে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি যজ্ঞ পরিচালনা করলেন। যজ্ঞের শেষে, যজ্ঞের চরুর সাথে অন্ধকমুনির দেওয়া বেলফলটি মিশিয়ে দেওয়া হলো।
রাজা দশরথ যজ্ঞের নৈবেদ্য দুটি ভাগে ভাগ করে বড়োরানি কৌশল্যা এবং মেজোরানি কৈকেয়ীকে দিলেন। কৌশল্যা ও কৈকেয়ী তাঁদের ভাগ থেকে সুমিত্রাকে নৈবেদ্য দিলেন। ঠিক সেই সময়ে, নারায়ণ চারভাগ হয়ে রাজা দশরথের ঘরে জন্ম নিলেন। প্রত্যেক রানির একটি করে পুত্র হল, তবে ছোটোরানি সুমিত্রার দু’টি পুত্র হল।
পুত্রদের ছ-মাস বয়সে, বশিষ্ঠ মুনি, অন্যান্য মুনি-ঋষিদের নিয়ে তাদের নামকরণ করলেন। কৌশল্যার পুত্রের নাম রাখা হল রাম, কৈকেয়ীর পুত্রের নাম রাখা হল ভরত এবং সুমিত্রার পুত্রদের নাম রাখা হল লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন।
এদিকে, নারায়ণ চার ভাগে রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন রূপে জন্ম নিলেন রাজা দশরথের ঘরে। আর এদিকে প্রজাপতি ব্রহ্মার ব্যবস্থামতো নারায়ণের পত্নী লক্ষ্মীদেবীকে একটি ডিমের মধ্যে শিশুকন্যা রূপে রাখা হল রাজা জনকের কৃষিক্ষেত্রে ।
একদিন রাজা জনক যখন কৃষিক্ষেত্রে লাঙল চালাচ্ছিলেন, তাঁর লাঙলের ফলায় উঠে এল সেই ডিম। লাঙলের দাগকে ‘সীতা’ বলা হয়, তাই রাজা জনক শিশুকন্যার নাম রাখলেন সীতা। জনকের ঘরে কন্যারূপে সেই শিশুকন্যা বড়ো হতে লাগলেন। যেহেতু রাজা জনকের কন্যা তাই তাঁর অন্য নাম জানকী। লক্ষ্মীদেবী রাজা জনকের ঘরে বড়ো হতে লাগলেন ।
এভাবেই শুরু হলো এক ঐতিহাসিক কাহিনী, যেখানে রাজা দশরথের পুত্ররা এবং রাজা জনকের কন্যার জন্ম হলো, যা পরবর্তী সময়ে মহাকাব্য রামায়ণের প্রধান চরিত্রদের রূপে আবির্ভূত হয়।
ছোটদের রামায়ণ কাহিনী:-অন্য দেবতাদের বানররূপে জন্মগ্রহণ
লঙ্কার রাজা রাবণের অত্যাচারে স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। অথচ, এই ত্রিভূবনে তাঁকে বধ করার কোনো সুযোগ ছিল না, কারণ তিনি ব্রহ্মার বর দানে অত্যন্ত বলীয়ান ছিলেন। ব্রহ্মা তাঁকে এমন একটি বর দিয়েছিলেন, “যে কোনো দেবতা ও দানব তাকে বধ করতে পারবে না।”
তাহলে কী করা যাবে এখন উপায় কি ? দেবতারা ভাবতে লাগলেন, অনেক চিন্তা করে উপায় বারকরলেন, ব্রহ্মা এরূপ কিছুতো বলেননি, যে মানুষের বা বানরের পক্ষে তাকে বধ করা সম্ভব হবে না। তাই দেবতারা অনুভব করলেন, মানুষ ও বানররূপে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করলেই রাবণকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে। নারায়ণ ইতিপূর্বে রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্নরূপে এবং লক্ষ্মীদেবী সীতারূপে মর্ত্যে এসেছেন। অতএব, অন্যান্য দেবতারা কিষ্কিন্ধ্যা নগরীতে বানররূপে জন্মগ্রহণ করলেন। উদ্দেশ্য, নর-বানরের মিলিত শক্তি যথাসময়ে রাবণকে ধ্বংস করে ত্রিভূবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে।
ছোটদের রামায়ণ কাহিনী:-অস্ত্রশিক্ষা, দুষ্টদমন ও বিবাহ
রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, ও শত্রুঘ্ন মহামুনি বশিষ্ঠের আশ্রমে থাকতেন এবং তাঁর কাছে সর্বশাস্ত্রের শিক্ষা লাভ করতেন। অস্ত্রশিক্ষার যাবতীয় বিদ্যাও তাঁরা অর্জন করেন।
এদিকে রাজর্ষি জনকের ঘরে সীতা বড়ো হতে থাকেন। তাঁকে বিবাহিত করতে হবে। তাই রাজা জনক স্থির করলেন যে, যে ব্যক্তি ‘হরধনু’ ভঙ্গ করতে পারবেন, তাঁর সঙ্গে সীতার বিবাহ দেবেন। তিনি বেশ জানেন, সীতার একমাত্র যোগ্য বর ছাড়া অন্য কেউ এই ‘হরধনু’ ভঙ্গ করতে পারবেন না ।
মিথিলায় মুনিরা মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন, কিন্তু রাক্ষস মারীচ ও তাঁর দলবল বারংবার যজ্ঞ পণ্ড করে দিচ্ছিল। এই রাক্ষসদের পরাজিত করতে বিশ্বামিত্র মুনি অযোধ্যায় যান এবং রাম ও লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে আসেন।
অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত রাম যাত্রাপথে ভয়ংকরী তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করেন। এবং গৌতম মুনির অভিশাপে পাথর হয়ে থাকা অহল্যাকে জীবন্ত করে তোলেন। এরপর তাঁরা মুনিদের যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলেন। এবং সেখানে রাম-লক্ষ্মণের হাতে একে একে বহু রাক্ষস নিধন হল। মারীচ কোনোরকমে পালিয়ে বাঁচল। এরপর মুনিরা তাঁদের যজ্ঞ সম্পন্ন করতে সক্ষম হলেন।
বিশ্বামিত্র মুনি এরপর রাম ও লক্ষ্মণকে রাজা জনকের গৃহে নিয়ে যান। পূর্বে অনেক রাজা সীতাকে বিবাহ করতে এসেছিলেন, কিন্তু কেউই হরধনুতে তির যোজনা করতে সক্ষম হননি। এমনকি রাবণও এসে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু যখন রাম সেখানে উপস্থিত হন, তিনি অতি সহজেই হরধনু হাতে তুলে নেন এবং তির যোজনা করার সময় সেই হরধনু ভেঙে যায়। উপস্থিত সকলেই রামের এই সফলতায় জয়ধ্বনি দেন।
তারপর বিশ্বামিত্র মুনি রাম-লক্ষ্মণকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন রাজা জনকের গৃহে পৌছলেন। ইতিপূর্বে যে সমস্ত রাজারা এসেছিলেন সীতাকে বিবাহ করতে, তাঁদের কেউ হরধনু কে ভাঙ্গতে পারেননি। রাবণও এসেছেন। তিনি হরধনু তুলতে না পেরে লজ্জায় পালিয়ে গেলেন। অবশেষে বিশ্বামিত্র মুনির সঙ্গে শ্রীরাম এলেন। অতি সহজেই শ্রীরাম হরধনু হাতে তুলে তো নিলেনই, হরধনুতে তির যোজনা করার সময় সেই হরধনু ভেঙ্গেও গেল । উপস্থিত সকলেই শ্রীরামের জয়ধ্বনি দিলেন।
রামের এই কৃতিত্বের খবর অযোধ্যার রাজা দশরথের কাছে পৌঁছায়। তিনি পাত্র, মিত্র, লোক এবং তাঁর দুই পুত্র ভরত ও শত্রুঘ্নকে সঙ্গে নিয়ে মিথিলায় পৌঁছান। সীতার সঙ্গে রামের বিবাহ হয়। লক্ষ্মণের সঙ্গে জনকের অন্য কন্যা ঊর্মিলার বিবাহ হয়। জনকের ভাই কুশধ্বজের দুই কন্যা মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তির সঙ্গে যথাক্রমে ভরত ও শত্রুঘ্নের বিবাহ হয়। পুত্র ও পুত্রবধূদের নিয়ে রাজা দশরথ মহা আনন্দে অযোধ্যায় ফিরে যান।