ছোটদের রামায়ণ: সংক্ষেপে রাম সীতার কাহিনী কিষ্কিন্ধ্যা ও সুন্দর কাণ্ড

ছোটদের রামায়ণ

ছোটদের রামায়ণের চতুর্থ অধ্যায় কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড

ছোটদের রামায়ণ: এই অধ্যায়ে শ্রীরামের সঙ্গে বানররাজ সুগ্রীবের মিত্রতার কথা বর্ণিত হয়েছে। রাম ও লক্ষ্মণ যখন সীতার সন্ধানে বের হন, তখন তাঁদের দেখা হয় সুগ্রীবের সঙ্গে, যিনি বালীর দ্বারা বিতাড়িত হয়ে কিষ্কিন্ধ্যার সিংহাসনে বসেছিলেন। রামের সাহায্যে বালীকে পরাজিত করে সুগ্রীব কিষ্কিন্ধ্যার রাজা হন এবং শর্তস্বরূপ রামকে সীতার সন্ধানে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন। এর পরই সীতার সন্ধানে বীর হনুমানসহ সুগ্রীব তাঁর বাহিনী পাঠান। বহু খোঁজাখুঁজির পর, হনুমান সমুদ্র পার করে লঙ্কায় পৌঁছান এবং দেবী সীতার সন্ধান পান।

এই অধ্যায়টি ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় রামায়ণের কাহিনী তুলে ধরে, যাতে তাঁরা সুগ্রীব ও হনুমানের সাহসিকতা, শৃঙ্খলা, এবং বন্ধুত্বের মূল্যবোধ সম্পর্কে জানতে পারে।

শ্রীরামের সঙ্গে সুগ্রীবের মিত্রতা

ছোটদের রামায়ণ: জটায়ুর কাছ থেকে রাক্ষসরাজ রাবণের সীতা হরণের কথা শুনে শ্রীরাম ক্রোধান্বিত হলেন। কীভাবে সীতাকে উদ্ধার করা যায়, তা ভাবতে ভাবতে তিনি ও লক্ষ্মণ ঋষ্যমূক পর্বতে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে তখন বসবাস করছিলেন বানররাজ সুগ্রীব ও তাঁর দলবল। সুগ্রীবের সঙ্গে তাঁর দাদা বালীর দ্বন্দ্ব চলছিল। বালী তাঁকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে কিষ্কিন্ধ্যার সিংহাসনে বসেছিলেন। এই সময় শ্রীরামের সঙ্গে সুগ্রীবের মিত্রতা হয়।

তাঁদের মধ্যে এক চুক্তি হয়— রাম যদি বালীকে বধ করে সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা করেন, তবে সুগ্রীবও সদলবলে সীতা উদ্ধারে রামকে সাহায্য করবেন। রামের পরামর্শ অনুযায়ী, বালী ও সুগ্রীবের মধ্যে মল্লযুদ্ধ শুরু হয়। তবে দুই ভাই দেখতে একই রকম হওয়ায়, সুগ্রীব চিনতে সুবিধা হয় এই জন্য তিনি গলায় একটি ফুলের মালা পরেন। যুদ্ধের সময় রাম আড়াল থেকে লক্ষ রাখেন এবং সঠিক সময়ে বালীকে লক্ষ্য করে বাণ ছোড়েন।

বালী নিহত হলে সুগ্রীব কিষ্কিন্ধ্যার সিংহাসনে বসেন, আর বালীর পুত্র অঙ্গদ যুবরাজ হন। এরপরই শুরু হয় সীতা উদ্ধারের অভিযান।


ছোটদের রামায়ণের সীতার সন্ধানে সুগ্রীবের অভিযান

সুগ্রীব রাজা হয়ে দেবী সীতার সন্ধানে মনোনিবেশ করলেন। সুগ্রীব আহ্বানে সাড়া দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য বানর কিষ্কিন্ধ্যায় উপস্থিত হলো। সুগ্রীব তাদের চারদিকে—পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণে প্রেরণ করলেন সীতার সন্ধানে।

দক্ষিণ দিকে যাত্রা করলেন যুবরাজ অঙ্গদ ও পবনপুত্র হনুমানসহ একদল বাহিনী। সুগ্রীব মনে করেছিলেন, বীর হনুমানই সীতার সন্ধান আনতে সক্ষম হবেন। তাই শ্রীরাম চন্দ্র নিজের হাতের একটি আংটি চিহ্ন স্বরূপ তাঁর হাতে খুলে দিলেন।

অনেক দিন কেটে গেল, কিন্তু কোনো বাহিনীই সীতার সন্ধান আনতে পারল না। এদিকে অঙ্গদ ও হনুমান খুঁজতে খুঁজতে সমুদ্রের ধারে এক পর্বতে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে তাঁদের দেখা হলো জটায়ুর দাদা শম্পাতির সঙ্গে। তিনি জানালেন, সীতা দক্ষিণ সমুদ্রের ওপারে রাবণের রাজপুরীতে বন্দি আছেন।

এই সংবাদ পেয়ে সবাই রামচন্দ্রের জয়ধ্বনি করে সমুদ্রের তীরে একত্রিত হলো। সে কি বিশাল সমুদ্র—প্রশস্ত একশো যোজন, ঢেউয়ে ঢেউয়ে উত্তাল তরঙ্গের খেলা। কীভাবে কী করে অতিক্রম করবে তাঁরা? সে চিন্তায় বিমর্ষ হয়ে পড়লেন যুবরাজ অঙ্গদ। ঠিক তখনই বীর হনুমান দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “আমি একলাফে সমুদ্র অতিক্রম করে সীতার সন্ধান এনে দেব!”


ছোটদের রামায়ণের পঞ্চম অধ্যায় সুন্দর কাণ্ড

ছোটদের রামায়ণ

ছোটদের রামায়ণে হনুমানের লঙ্কা অভিযান

একশো যোজন বিস্তৃত বিশাল সমুদ্র! পবনপুত্র মহাবীর হনুমান সংকল্প করলেন, এই সমুদ্র তিনি অতিক্রম করেই লঙ্কায় পৌঁছাবেন। মহেন্দ্র পর্বতের চূড়ায় উঠে ব্রহ্মা, ইন্দ্রসহ দেবতাদের স্মরণ করে এক দুর্দান্ত লাফ দিলেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যে আকাশপথে লঙ্কাপুরীর দিকে এগিয়ে চললেন বীর হনুমান।

লঙ্কার সীমানায় পৌঁছে নিজের দেহ অত্যন্ত ক্ষুদ্র করে ফেললেন, যাতে কেউ তাঁকে দেখতে না পায়। সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে সোনার লঙ্কাপুরী। চারপাশে কড়া পাহারা দিচ্ছে শত শত রাক্ষস, হাতে তাদের তীক্ষ্ণ অস্ত্র। এখনই নগরীতে প্রবেশ করলে বিপদের সম্ভাবনা প্রবল। তাই হনুমান সন্ধ্যা পর্যন্ত লঙ্কার প্রাচীরের আড়ালে লুকিয়ে রইলেন।

রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে এলে হনুমান মন্ত্রবলে নিজের শরীর আরও ক্ষুদ্র করে নিঃশব্দে প্রবেশ করলেন লঙ্কাপুরীতে। কেউ কিছু টের পেল না।

লঙ্কার অপার ঐশ্বর্য, সুসজ্জিত রাজপ্রাসাদ, উঁচু অট্টালিকা ও মনোরম পরিবেশ দেখে বিস্মিত হলেন হনুমান। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য এক— মাতৃসম সীতা দেবীর সন্ধান করা। রাজা রাবণের রাজপ্রাসাদের প্রতিটি কোণে খুঁজেও কোথাও তাঁকে দেখা গেল না। কোথায় আছেন সীতা? হনুমান বিভ্রান্ত হলেন।

শেষ পর্যন্ত, একসময় তিনি পৌঁছালেন অশোকবনে। সেখানে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখলেন— এক পরমাসুন্দরী রমণী, যিনি বিমর্ষ মুখে এক গাছের নীচে বসে আছেন। তাঁর বেশবাস মলিন, মুখে বিষাদ। চারপাশে কয়েকজন রাক্ষসী তাঁকে পাহারা দিচ্ছে। রমণীটি কারও দিকে তাকাচ্ছেন না, শুধু মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলছেন— “শ্রীরাম!”

হনুমানের আর বুঝতে বাকি রইল না— ইনি-ই জনকনন্দিনী, অযোধ্যার রাজমাতা, শ্রীরামচন্দ্রের প্রিয়তমা, দেবী সীতা! রাত গভীর হলে পাহারাদার রাক্ষসীরা চলে গেল। তখন হনুমান নিঃশব্দে সীতার সামনে এসে দাঁড়ালেন। শ্রীরামের দেওয়া অমূল্য আংটিটি তিনি তুলে ধরলেন এবং বিনীত স্বরে বললেন— “মাতা! আমি শ্রীরামের ভক্ত। আপনাকে খুঁজতেই এখানে এসেছি। ভয় পাবেন না।”

হনুমানের কথা শুনে সীতা আবেগে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। রামের জন্য তাঁর হৃদয় আকুল হয়ে উঠল। তখন হনুমান বললেন— “আমাকে দ্রুত শ্রীরামের কাছে ফিরে যেতে হবে, তাঁরা খুবই চিন্তিত। কিন্তু আমি কীভাবে প্রমাণ দেব যে আমি আপনার সন্ধান পেয়েছি?” এ কথা শুনে দেবী সীতা নিজের মাথার চূড়ামণিটি খুলে চিহ্নস্বরূপ হনুমানের হাতে তুলে দিলেন। হনুমান তখনই সংকল্প করলেন— এবার শ্রীরামকে সংবাদ পৌঁছে দিতেই হবে!


ছোটদের রামায়ণ

ছোটদের রামায়ণের হনুমানের লঙ্কা দহনলঙ্কা থেকে প্রত্যাবর্তন

হনুমান দেবী সীতার সন্ধান পেয়েছেন, তাঁর মনে আর কোনো সংশয় বা আফশোস নেই। এবার তিনি স্বর্ণলঙ্কার বুকে তাণ্ডব শুরু করলেন। মনের সুখে লঙ্কার রাজপ্রাসাদ, অট্টালিকা ও বাগিচা একের পর এক তছনছ করে দিলেন। অবশেষে, তিনি স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন।

রাবণ রাগে ফেটে পড়লেন এবং আদেশ দিলেন— “এই বীরত্ব দেখানো বানরকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। ওর বিশাল লেজে কাপড় জড়িয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দাও!” তিনি ভেবেছিলেন, হনুমান এই অগ্নিশিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। কিন্তু ঘটল ঠিক তার উল্টো! হনুমান সেই দহনশিখাকে অস্ত্র করে পুরো লঙ্কাপুরী জ্বালিয়ে দিলেন।

এরপর দেবী সীতার সন্ধান নিয়ে হনুমান ফিরে এলেন কিষ্কিন্ধ্যায়। শ্রীরামকে তুলে দিলেন দেবী সীতার পাঠানো মাথার চূড়ামণি। এতে সকলেই নিশ্চিত হলেন— সীতা দেবীকে লঙ্কার অশোকবনে অপহরণ করে রাখা হয়েছে। আর দেরি করা যাবে না।

সুগ্রীব তাঁর বিশাল বানরবাহিনী নিয়ে সমুদ্রতীরে এসে উপস্থিত হলেন। শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু সামনে বিশাল সাগর! এখন এই গগনচুম্বী ঢেউ পেরিয়ে তাঁরা লঙ্কায় পৌঁছাবেন কীভাবে?

সনাতন ধর্মের জ্ঞানের আরো কিছু পোস্ট

*ছোটদের রামায়ণ অযোধ্যা ও অরণ্য কাণ্ড।

* ছোটদের রামায়ণ সংক্ষিপ্ত কাহিনী আদিকাণ্ড

Share Please:

নমস্কার "আমি শ্রী কালিপদ, একজন হিন্দু সনাতনী। আমার লক্ষ্য হল আমার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সনাতন ধর্ম এবং হিন্দু সংস্কৃতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আমি হিন্দু ধর্মের প্রাচীন ঐতিহ্য, ধর্মগ্রন্থ, এবং আধ্যাত্মিকতার জ্ঞান সহজ ভাষায় উপস্থাপন করার চেষ্টা করি, যাতে সকলেই এই মহান ধর্মের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি যে সনাতন ধর্ম শুধু একটি ধর্ম নয়, এটি একটি জীবনধারা, যা আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং জীবনের প্রকৃত অর্থ বোঝায়।"

Leave a Comment