প্রতি বৃহস্পতিবারের ব্রত কথা: বৃহস্পতিবার ব্রতকথা ও লক্ষ্মীর পাঁচালী

প্রতি বৃহস্পতিবারের ব্রত কথা

প্রতি বৃহস্পতিবারের ব্রত কথা: মা লক্ষ্মীর ব্রত হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার, যা মূলত শ্রীবিষ্ণু ও মা লক্ষ্মীর কৃপা লাভের উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, এই ব্রত পালনের মাধ্যমে জীবনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সুখ-শান্তি ও সৌভাগ্য বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে গৃহস্থ নারীরা সংসারের মঙ্গল ও সমৃদ্ধির কামনায় এই ব্রত নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতি বৃহস্পতিবার পালন করেন।

প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পাঁচালী

নারায়ণং নমস্কৃত্যং নরঞ্চৈব নরোত্তমম্।
দেবীং সরস্বতীঞ্চৈব ততো জয় মুদীরয়েৎ ৷৷
বন্দে বিষ্ণুপ্রিয়াং দেবীং দারিদ্র্য-দুঃখ নাশিনীম্‌ ।
ক্ষীরোদপুত্রীং কেশবকান্তাং বিয়োবক্ষ বিলাসিনীং ৷৷


দোলপূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ। মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস ৷৷
লক্ষ্মীদেবী বামে লয়ে বসি নারায়ণ।
মনোসুখে নানা কথা করে আলাপন ৷৷ হেনকালে বীণা করে আসে মুনিবর।
প্রবেশ করেন আসি বৈকুণ্ঠ নগর ৷৷
উভয়ের শ্রীচরণে করিল প্রণতি। নারদ কহিল তবে লক্ষ্মীদেবী প্রতি ৷৷
কি কারণে ঋষিবর এসেছ হেথায়।
লক্ষ্মীরে বলিল ঋষি নমি পুনরায় ৷৷ মানুষের প্রতি তব কেন অবিচার।
চঞ্চলা চপলা প্রায় ফেরো দ্বারে দ্বার ৷৷
ক্ষণকাল তরে তব নাহি কোথা স্থিতি। সেইহেতু নর-নারী ভোগয়ে দুৰ্গতি ৷৷
সতত কুক্রিয়াসক্ত নরনারীগণ।
অসহ্য যাতনা পায় দেখি অনুক্ষণ ৷৷ অন্নাভাবে শীর্ণকায় শক্তিহীন দেহ।
বহুদুঃখে আত্মহত্যা করিতেছে কেহ ৷৷
নিজ প্রাণ সম কেহ পুত্র কন্যাগণে । করিতেছে পরিত্যাগ অন্নের কারণে ৷৷
বল দেখি মোর কাছে কি পাপের ফলে।


ভীষণ দুর্ভিক্ষে সদা মর্ত্যবাসী জ্বলে ৷৷ ঋষিবাক্য শুনি লক্ষ্মী দুঃখিত অন্তরে।
কহিলেন অতঃপর ক্ষুণ্ণ মুনিবরে ৷৷
মর্ত্যবাসী দুঃখ পায় শোকের বিষয়। দুষ্কর্মের ফল ইহা জানিবে নিশ্চয়৷৷
চঞ্চলা আমার নাম কিসের লাগিয়া।
ইহার কারণ ঋষি শুন মন দিয়া ৷৷ দেব দ্বিজে নাহি মানে যত নারী নর।
অশাস্ত্রকে শাস্ত্রজ্ঞান করে নিরন্তর ৷৷
অনাচারে মজে গেছে সমাজ সংসার। এইরূপ স্থানে থাকা দুষ্কর আমার ৷৷
আপন আপন ধর্ম দিয়া বিসর্জন।
পরধর্ম লয়ে মত্ত হয়েছে এখন ৷৷ তী দিবানিদ্রা অনাচার ক্রোধ অহঙ্কার।
আলস্য কলহ মিথ্যা ঘিরিছে সংসার ৷৷
উচ্চহাসি কটুকথা কহে নারীগণ। তা সন্ধ্যাকালে নিদ্রা যায় হয়ে অচেতন ৷৷
সন্ধ্যায় তাহারা ধূপ দীপ নাহি জ্বালে।
ভা সিন্দুর এয়োতী চিহ্ন নাহি পরে ভালে ৷৷ প্রভাতে দেয় না কেহ গোবরের ছড়া।
ঘৃণা নাহি করে তারা বাসিবস্ত্র পড়া ৷৷


লক্ষ্মী স্বরূপিণী নারী করিয়া সৃজন। পাঠায়েছি মর্ত্যলোকে সুখের কারণ ৷৷
ক্ষণিকের সুখে তারা ভুলিয়া আমায়।
অকাজে কুকাজে সবে সংসার মজায় ৷৷ শ্বশুর শাশুড়ী প্রতি নহে ভক্তিমতী।
সদা বলে কটুবাক্য তাহাদের প্রতি ৷৷
স্বামীর আত্মীয়গণে না করে আদর। থাকিতে সকলে চায় হয়ে স্বতন্তর ৷৷
লজ্জা আদি যত গুণ রমণী ভূষণ।
ক একে একে সব তারা করিছে বর্জন৷৷ রমণী ভূষণ সব দিয়া বিসর্জন।
কী যথায় তথায় করে স্বেচ্ছায় গমন ৷৷
অতিথি দেখিলে তারা রুষ্ট হয় মনে। স্বামীর অগ্রেতে খায় যত নারীগণে ৷৷
স্বামীরে করিছে হেলা শুনে না বচন
ছেড়েছে সংসার ধর্ম ছেড়েছে রাজন ৷৷ নারীগণ সঙ্গে নর সময় কাটায়।
মিথ্যা ছাড়া সত্যকথা কভু নাহি কয় ৷৷
সতত তাহারা মোরে করে জ্বালাতন । বঞ্চনায় প্রায় তাই করি যে ভ্রমণ ৷৷
দ্বেষ-হিংসা পূর্ণ সদা তাদের হৃদয়।


পরশ্রীকাতর চিত্ত কুটিলতাময় ৷৷ দেবতায় ভক্তিহীন তুচ্ছ গুরুজন।
সর্বদা নিজের সুখ করে অন্বেষণ ৷৷
রসনা তৃপ্তির লাগি অখাদ্য ভোজন। সে কারণে হয় ঋষি কুষ্ঠ আক্রমণ ৷৷
প্রতি গৃহ এইরূপ পাপের আগার।
অচলা হইয়া আমি থাকি কি প্রকার ৷৷ এইসব দোষ ত্যজি হলে সদাচারী।
অচলা হইয়া আমি থাকিতে যে পারি।
ইহা শুনি ঋষিবর বলে ক্ষুণ্নমনে। কেমনে প্রসন্না মাগো হবে নরগণে ৷৷
কিরূপে পাইবে তব পদছায়া।
যদি তুমি দয়াময়ী না করিবে দয়া ৷৷ সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের তুমি অধিকারী।
জগৎ জননী তুমি—জগৎ ঈশ্বরী ৷৷
বলো মাগো কৃপা করি ইহার বিধান। মানবের দুঃখ দেখি কাঁদে মোর প্রাণ ৷৷
শুনিয়া লক্ষ্মীর মনে দয়া উপজিল।
মধুর বচনে তাঁরে বিদায় করিল ৷৷ নর-নারী দুঃখ দেখি কাঁদিছে অন্তর।
প্রতিকার আমি বাছা করিব সত্ত্বর ৷৷


অতঃপর লক্ষ্মীদেবী চিন্তা করে মনে। মর্ত্যের এ দুঃখ নাশ করিব কেমনে ৷৷
কিরূপে তাদের দুঃখ করিব মোচন।
উপদেশ দেহ মোরে প্রভু নারায়ণ ৷৷ শুনিয়া লক্ষ্মীর কথা কহেন শ্রীপতি।
চঞ্চল হয়ো না প্রিয়ে স্থির কর মতি ৷৷
একমনে শুন দেবী আমার বচন। লক্ষ্মীব্রত মর্ত্যধামে কর প্রচারণ ৷৷
প্রতি গুরুবারে মিলি যত নারীগণে।
পূজিয়া শুনিবে কথা ভক্তি যুক্ত মনে ৷৷ ধনৈশ্বর্য্য্য বৃদ্ধি পাবে তোমার কৃপায়।
সর্ব দুঃখ দূরে যাবে কহিনু নিশ্চয় ৷৷
নারায়ণ বাক্যে লক্ষ্মী প্রফুল্লিত মনে। গমন করেন মর্ত্যে ব্রত প্রচারণে ৷৷
অবন্তী নগরে শেষে হৈল উপনীত।
দেখিয়া হলেন লক্ষ্মী অত্যন্ত স্তম্ভিত ৷৷ নগরের অধীশ্বর ধনেশ্বর রায়।
অতুল ঐশ্বর্য্য তাঁর কুবেরের প্রায় ৷৷
সোনার সংসার তাঁর নাহি হিংসা দ্বেষ। পালিত সবারে তিনি পুত্র নির্বিশেষ ৷৷
এক অন্নে শত পুত্র রাখি ধনেশ্বর।


সসম্মানে যথাকালে গেল লোকান্তর ৷৷ পত্নীর কুহক জালে শত সহোদর।
পৃথক হইল সবে কিছুদিন পর ৷৷
হিংসা দ্বেষ অলক্ষ্মীর যত সহচর। একে একে সবে আসি প্রবেশিলা ঘর ৷৷
এ সকল দোষ দেখি ক্রোধিত অন্তরে।
ধনেশ্বর গৃহলক্ষ্মী ছাড়িলা সত্ত্বরে ৷৷ বৃদ্ধা ধনেশ্বর পত্নী নিজ ভাগ্য দোষে।
তিষ্ঠিতে পারে না আর বধূদের রোষে ৷৷
কাননে চলিল বৃদ্ধা ত্যজিতে জীবন। অদৃষ্টের ফলে হয় এ হেন ঘটন ৷৷
অন্নাভাবে শীর্ণ দেহে মলিন বসন।
চলিবার শক্তি নাই করিছে ক্রন্দন ৷৷ হেনকালে বৃদ্ধাবেশে লক্ষ্মী ঠাকুরাণী।
পথিমধ্যে উপনীত হলেন আপনি ৷৷
সদয় হইয়া লক্ষ্মী জিজ্ঞাসে বৃদ্ধারে। কি কারণে আসিয়াছ এঘোর কান্তারে ৷৷
কাহার তনয়া তুমি কাহার ঘরণী।
কি হেতু মলিন মুখ বল দেখি শুনি ৷৷ বৃদ্ধা বলে কি বলিব আমার কাহিনী।
পতীহীনা আমি মাগো মন্দ কপালিনী।


পিতা-পতি ছিল মোর অতি ধনবান। সর্বদা গৃহেতে ছিল লক্ষ্মী অধিষ্ঠান৷৷
সোনার সংসার মোর ছিল ধনে জনে ।
পুত্র, পুত্রবধূগণ সেবিত যতনে ৷৷ পতির মৃত্যুর পর সুখ-শান্তি যত।
গৃহ হতে ক্রমে সব হল তিরোহিত ৷৷
সাত পুত্র সাত হাঁড়ি হয়েছে এখন। সতত জ্বালায় মোরে সপ্তবধূগণ ৷৷
সহিতে না পারি আর তাদের লাঞ্ছনা।
জীবন ত্যজিতে মাগো করেছি বাসনা ৷৷ লক্ষ্মী বলে শুন তুমি আমার বচন।
আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন ৷৷
যাও তুমি গৃহে ফিরে, কর লক্ষ্মীব্রত। অচিরে হইবে তব সুখ পূর্বমত ৷৷
গুরুবারে সন্ধ্যাকালে লয়ে বধূগণে ।
করিবে লক্ষ্মীর ব্রত হয়ে একমনে ৷৷ জলপূর্ণ ঘটে দিবে সিন্দুরের ফোঁটা।
আমের পল্লব তাহে দিবে এক গোটা ৷৷
আসন সাজায়ে তাহে দিবে গুয়াপান। সিন্দুর গুলিয়া দিবে ব্রতের বিধান ৷৷
ধূপ দীপ জ্বালাইয়া রাখিবে দ্বারেতে।


শুনিতে বসিবে কথা দূর্বা লয়ে হাতে ৷৷ মনে মনে লক্ষ্মী মূর্তি করিয়া চিন্তন।
একমনে ব্রতকথা করিবে শ্রবণ ৷৷
কথা শেষে উলু দিয়া প্রণাম করিবে। ভক্তি ভরে এয়োগণে সিন্দুর পরাবে ৷৷
যেই নারী পূজা করে প্রতি গুরুবারে।
হইবে বিশুদ্ধ মনা লক্ষ্মীদেবীর বরে ৷৷ যেই গৃহে ব্রতকথা হয় বারোমাস।
সর্বদা তাহারে গৃহে করি বসবাস ৷৷
তার গৃহে থাকি আমি হইয়া অচলা। পূর্ণ করি মনোবাঞ্ছা আমি যে কমলা ৷৷
গুরুবারে হয় যদি পূর্ণিমা উদিত।
যেই নারী উপবাসে করে লক্ষ্মীব্রত ৷৷ সকল বাসনা তার অবশ্য পূরিবে।
পতিপুত্র লয়ে সুখে চিরকাল রবে ৷৷
লক্ষ্মীর ভাণ্ডার স্থাপি যেবা নিজ ঘরে। রাখিবে তণ্ডুল তাহে এক মুষ্টি করে ৷৷
সঞ্চয়ের পথ ইহা জানিবে নিশ্চয়।
এর ফলে উপকার পাবে অসময় ৷৷ আলস্য ত্যজিয়া সূতা কাট নারীগণে।
অন্নবস্ত্র কষ্ট যাবে শাস্ত্রের বচনে ৷৷


প্রসন্না থাকিব আমি কহিলাম সার। গৃহে গিয়ে কর তুমি ব্রতের প্রচার ৷৷
এত বলি লক্ষ্মীদেবী নিজ মূর্ত্তি ধরি।
দরশন দিল তারে দেবী কৃপা করি৷৷ লক্ষ্মীরে দেখিয়া বৃদ্ধা আনন্দে বিভোর।
প্রণাম করিল বৃদ্ধা জুড়ি দুই কর ৷৷
প্রসন্না হইয়া লক্ষ্মী দিল তারে কোল। বুঝালেন আরো কত বলি মিষ্ট বোল্৷৷
লক্ষ্মী বলে ব্রত মোর কর প্রচারণ।
ধনধান্যে পূর্ণ হবে তোমার ভবন ৷৷ পুত্র-পুত্রবধূগণ বশে থাকিবে তোমার।
পূর্বমত শান্তিময় হইবে সংসার ৷৷
সব বুঝাইয়া লক্ষ্মী হৈলা অদৰ্শন। চা আনন্দে করিল বৃদ্ধা গৃহতে গমন ৷৷
গৃহে বৃদ্ধা বধূগণে সকলি বলিল।
লক্ষ্মী দরশন বলে যে রূপে ঘটিল ৷৷ ব্রতের নিয়ম বৃদ্ধা বলিল সবারে।
বলেছেন লক্ষ্মী যাহা অরণ্য মাঝারে ৷৷
একদিন গুরুবারে অবন্তী নগরে। এয়োগণ মিলি সব লক্ষ্মীব্রত করে ৷৷
শ্রীনগরবাসী এক বণিক তনয়।


দৈবযোগে সেই স্থানে উপনীত হয় ৷৷ অনেক সম্পত্তি তার ভাই পঞ্চজন।
পরস্পর অনুগত থাকে সর্বক্ষণ ৷৷
লক্ষ্মীকোপে পড়ি সেই বণিক নন্দন। তরীসহ জলমধ্যে হইলা মগন ৷৷
অট্টালিকা আদি করি যাহা ছিল তার।
বজ্রাঘাতে দগ্ধ হয়ে হৈল ছারখার ৷৷ ভ্রাতাসহ দ্বন্দ্ব হৈল সব ছিন্ন ভিন্ন।
সোনার সংসার তার হইল বিপন্ন ৷৷
ভিক্ষার লাগিয়া সবে ফিরে দ্বারে দ্বারে। পেটের জ্বালায় গেল দেশ দেশান্তরে ৷৷
ভীষণ বিপদে পড়ি সাধু মহাশয়।
অবিরত কাঁদে আর করে হায় হায় ৷৷ কিবা দোষ দেখি বিধি করিলে এমন ।
অধম সন্তান আমি অতি অভাজন ৷৷
সাধুর দুর্দশা হেরি দয়া উপজিল। করুণ হৃদয়া লক্ষ্মী সকলি ভুলিল ৷৷
দুঃখ তরে তারে করিয়া কৌশল।
পাঠায় অবন্তী ধামে করি ভিক্ষা ছল ৷৷ নানাদেশ ঘুরাইয়া সেই সদাগরে।
উপনীত করাইল অবন্তী নগরে ৷৷


দেখে সেথা লক্ষ্মীব্রত করে এয়োগণ। পূর্বের বৃত্তান্ত তার হইল স্মরণ ৷৷
বুঝিল তখন কেন পড়েছে বিপাকে।
অহঙ্কার দোষে লক্ষ্মী ছাড়িয়াছে তাকে ৷৷ সুর-নর সকলের সম্পদ রূপিণী।
জগৎ ঈশ্বরী তুমি ঐশ্বৰ্য দায়িনী ৷৷
রাস অধিষ্ঠাত্রী দেবী তুমি রাসেশ্বরী। সকলেই তব অংশে আছে যত নারী ৷৷
গোলোকে কমলা তুমি মাধবমোহিনী।
ক্ষীরোদ-সাগরে তুমি ক্ষীরোদ নন্দিনী ৷৷ জোড় করে ভক্তিভরে বণিক নন্দন।
করিছে লক্ষ্মীর স্তুতি হয়ে একমন ৷৷
ক্ষমা কর ওগো মাতা অপরাধ যত। অধম সন্তানে দয়া করহ সতত ৷৷
অধম অজ্ঞান আমি মোরে কর দয়া ৷
বিপাকে পড়েছি মাগো দেহ পদছায়া ৷৷ শ্রেষ্ঠ হতে শ্রেষ্ঠতরা পরমা প্রকৃতি।
কোপাদি বর্জিতা তুমি মূর্তিমতী সতী ৷৷
সতী সাধ্বী রমণীর তুমি মা উপমা। ভক্তিভরে দেবগণ সদা পূজে তোমা ৷৷
মহালক্ষ্মী রূপে তুমি ত্রিদিব মণ্ডলে।


গৃহলক্ষ্মী রূপে মাগো বিরাজ ভূতলে ৷৷ তুমি মা তুলসী, গঙ্গা পতিত পাবনী।
সাবিত্রীর বিরিঞ্জি পুরে বেদের জননী ৷৷
গৃহে ফিরে যেই নারী করে লক্ষ্মীব্রত। ভক্তি ভাবে এয়ো লয়ে পূজে বিধিমত ৷৷
বধূগণ মিলি সবে করে লক্ষ্মীব্রত।
হিংসা দ্বেষ মন হতে হলো বিদূরিত ৷৷ ব্ৰতফলে এক হৈল সপ্ত সহোদর।
ধনৈশ্বর্য্যে পূর্ণ হলো তাহাদের ঘর ৷৷
মা লক্ষ্মী করিল তথা পুনঃ আগমন। অচিরে হইল গৃহ শান্তি নিকেতন ৷৷
দৈবক্রমে একদিন সাধুর ভবনে।
এক নারী ব্রতকালে এলো সেইখানে ৷৷ ব্রতকথা শুনি তার ভক্তি উপজিল।
তার মনে মনে লক্ষ্মীব্রত মানত করিল ৷৷
স্বামী তার কুষ্ঠরোগী অক্ষম অর্জনে। ত ভিক্ষা করি যাহা পায় খায় দুইজনে ৷৷
মনে মনে সেই নারী করিল বাসনা।
পতিরে নীরোগ কর ইহাই কামনা ৷৷ দেবের কৃপায় তার দুঃখ হৈল দূর।
কী নীরোগ হইল পতি ঐশ্বর্য্য প্রচুর ৷৷


ক্রমে ক্রমে তাদের জন্মিল তনয়। হইল সংসার তার সুখের আলয় ৷৷
এইরূপে ব্রত হয় প্রতি ঘরে ঘরে।
ক্রমেতে প্রচার হয় অবন্তী নগরে ৷৷ অবশেষে ঘটে এক অপূর্ব ব্যাপার।
ব্রতের মাহাত্ম্য যে ভাবে হৈল প্রচার ৷৷
বৃন্দাবনে তুমি মাগো কৃষ্ণ প্রাণাধিকা। দ্বাপর যুগেতে মাগো তুমিই রাধিকা ৷৷
বৃন্দাবনে তুমি মাগো বৃন্দা গোপনারী।
নন্দালয়ে তুমি ছিলে হয়ে গোপেশ্বরী ৷৷ চম্পকের বনে তুমি চম্পক ঈশ্বরী।
শত শৃঙ্গ পর্বতেতে শোভিতা সুন্দরী ৷৷
বিকশিত পদ্মবনে তুমি পদ্মাবতী। মালতী কুসুম বনে তুমি মা মালতী ৷৷
কুন্দদন্তী নাম তব হয় কুন্দবনে।
সুশীলা তোমার নাম কেতকী কাননে ৷৷ তুমি মা কদম্ববতী কদম্ব কাননে।
বনেশ্বরী হয়ে আছ তুমি বনে বনে ৷৷
রাজলক্ষ্মী নাম ধর তুমি রাজপুরে। গৃহলক্ষ্মী রূপে আছ তুমি ঘরে ঘরে ৷৷
দীনজনে রাজ্য লভে তব কৃপাবলে।


কর মা দীনেরে দয়া ওগো মা কমলে ৷৷ ক্ষেমঙ্করী দয়াময়ী অধম তারিণী ।
ক্ষমা কর অপরাধ দুঃখ বিনাশিনী ৷৷
অন্নদা বরদা তুমি বিপদ নাশিনী । দয়া কর দয়াময়ী মাধব ঘরণী ৷৷
এইরূপে বহু স্তব করি মনে মনে।
ভক্তি যুক্ত চিত্তে সাধু প্রণমে সেখানে ৷৷ ব্রতকথা শুনি সাধু করিয়া প্রণাম।
ব্রতের মানত করি আসে নিজ ধাম ৷৷
গৃহিণীকে বলে সাধু লক্ষ্মীব্রত সার। সবে মিলে কর ব্রত প্রতি গুরুবার ৷৷
সাধুর কথায় তুষ্ট হয়ে বধূগণ।
ভক্তিভরে করে সবে ব্রত আচরণ ৷৷ ভক্তাধীনা নারায়ণী হইয়া সদয়।
নাশিল সাধুর লক্ষ্মী যত বিঘ্নচয় ৷৷
দেবীর কৃপায় মিলে ভাই বধূগণ। দারিদ্রতা দূরে গিয়ে নিরাপদ হন ৷৷
বাণিজ্য তরণী ভাসে জলের উপর।
মহানন্দে পূর্ণ হলো সাধুর অন্তর ৷৷ ভ্রাতা আর বধূগণ হইল মিলন।
সাধুর সংসার হলো শান্তি নিকেতন ৷৷


এইরূপে মর্ত্যধামে ব্রতের প্রচার। জেনো মনে পৃথিবীতে লক্ষ্মীব্রত সার ৷৷
যেই নারী এই ব্রত করে একমনে।
লক্ষ্মীর কৃপায় তার বাড়ে ধনে জনে ৷৷ পুত্রহীন পায় পুত্র নির্ধনের ধন।
ইহলোকে সুখ অন্তে বৈকুণ্ঠে গমন ৷৷
লক্ষ্মীব্রত কথা জেনো বড়ই মধুর। এ ব্রতের ফলে সব দুঃখ হয় দূর ৷৷
যেবা পড়ে যেবা শুনে যেবা রাখে ঘরে।
লক্ষ্মীর বরেতে তার মনোবাঞ্ছা পুরে ৷৷ লক্ষ্মীর ব্রতের কথা অতি মধুময়।
প্রণাম করিয়া যাও যে যার আলয় ৷৷
করজোড়ে গলবস্ত্রে ভক্তি যুক্ত মনে। দেবীকে প্রণাম কর যে থাক যেখানে ৷৷
প্রণমামি লক্ষ্মী মাগো বিষ্ণুর ঘরণী।
ক্ষীরোদ সাগর পুত্রী জগৎ পালিনী ৷৷ অগতির গতি তুমি, তুমি নারায়ণী।
জগতের মাতা তুমি বিপদ নাশিনী ৷৷
ব্রত করি স্তব পাঠ যেই জন করে। অভাব রহে না তার মা লক্ষ্মীর বরে ৷৷
লক্ষ্মী ব্রতের কথা হইল সমাপন।


ভক্তিভরে চাহ বর যার যাহা মন ৷৷ সিঁথিতে সিন্দুর দাও সব এয়ো মিলে।
হুলুধ্বনি শঙ্খধ্বনি কর সবে মিলে ৷৷
ভকত বৎসলা দেবী সত্য স্বরূপিণী। হরিপ্রিয়া মহালক্ষ্মী ভূ-ভার হারিণী ৷৷
চঞ্চলা কমলা মাগো ত্রিলোক তারিণী।
চরণে প্রণমি মাগো মাধব রঞ্জিনী ৷৷ ভবের আরাধ্য তুমি দারিদ্র্য নাশিনী।
কৃপা কর কৃপাময়ী ত্রিতাপ-জারিণী ৷৷

শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা সমাপ্ত

প্রতি বৃহস্পতিবারের ব্রত কথার মাহাত্ম্য

  • প্রতি বৃহস্পতিবার ব্রতকথা পাঠ ও উপবাস করলে জীবনে নানা ধরনের বাধা-বিপত্তি দূর হয়। এই ব্রত পালন করলে—
  • সংসারে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে।
  • শ্রীবিষ্ণুর কৃপা লাভ করা যায়।
  • মহালক্ষ্মীর আশীর্বাদে ঘরে ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায়।

বৃহস্পতিবার ব্রতকথা পালনের নিয়ম

  • বৃহস্পতিবার সকালে স্নান সেরে পরিষ্কার বাসন-পত্রে প্রসাদ তৈরি করুন।
  • একমনে শ্রীবিষ্ণু ও লক্ষ্মী দেবীর পুজো করুন।
  • বৃহস্পতিবার ব্রতকথা পড়ুন ও অন্যদের শোনান।
  • এই দিনে বাস্তুতন্ত্র অনুযায়ী কলা গাছ পূজা করা শুভ বলে মনে করা হয়।
  • ব্রত পালনকারীরা হলুদ রঙের পোশাক পরিধান করলে শুভ ফল লাভ হয়।

লক্ষ্মীর পাঁচালী ও বৃহস্পতিবার ব্রত

লক্ষ্মী দেবীর কৃপা পাওয়ার জন্য লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৃহস্পতিবার ব্রতের সময় লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়লে দেবী লক্ষ্মী প্রসন্ন হন এবং সংসারে ধন-সম্পদ ও সৌভাগ্য বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার

বৃহস্পতিবার ব্রত পালনের মাধ্যমে জীবনের নানা সমস্যা দূর হয় এবং ধন-সম্পদের সমৃদ্ধি ঘটে। প্রতি বৃহস্পতিবার নিয়ম মেনে ব্রত পালন করলে শ্রীবিষ্ণু ও লক্ষ্মী দেবীর আশীর্বাদ লাভ সম্ভব। আপনি যদি জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি চান, তবে প্রতি বৃহস্পতিবারের ব্রত কথা মেনে চলুন এবং লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ করুন।


আমাদের অন্য পোস্ট গুলি পড়ুন।

*একাদশী উপবাসের নিয়ম।

*অঙ্গে মাখো মাখো রে এই না ব্রজের ধুলা।

Share Please:

নমস্কার "আমি শ্রী কালিপদ, একজন হিন্দু সনাতনী। আমার লক্ষ্য হল আমার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সনাতন ধর্ম এবং হিন্দু সংস্কৃতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আমি হিন্দু ধর্মের প্রাচীন ঐতিহ্য, ধর্মগ্রন্থ, এবং আধ্যাত্মিকতার জ্ঞান সহজ ভাষায় উপস্থাপন করার চেষ্টা করি, যাতে সকলেই এই মহান ধর্মের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আমি বিশ্বাস করি যে সনাতন ধর্ম শুধু একটি ধর্ম নয়, এটি একটি জীবনধারা, যা আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং জীবনের প্রকৃত অর্থ বোঝায়।"

Leave a Comment