
দ্বিতীয় অধ্যায় সংক্ষেপ রামায়ণ কাহিনী অযোধ্যা কাণ্ড
রামায়ণ কাহিনী সংক্ষেপ: রামায়ণ হল হিন্দু ধর্মের অন্যতম মহাকাব্য, যা মহর্ষি বাল্মীকি রচিত। এটি প্রধানত ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের জীবন কাহিনি ও নীতিবোধের শিক্ষা প্রদান করে। ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা এই সংস্করণে রামের জন্ম, কৈকেয়ীর কূটচাল, রামের বনবাস, সীতাহরণ ও লঙ্কাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি তুলে ধরা হয়েছে। এতে নৈতিক শিক্ষা, ভক্তি, ত্যাগ ও সত্যের পথে অবিচল থাকার বার্তা রয়েছে, যা ছোটদের জন্য শিক্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর।
রামায়ণ কাহিনী সংক্ষেপ রাম-সীতা-লক্ষ্মণের বনে গমন
অযোধ্যার রাজা দশরথ সুখে ও আনন্দে দিন কাটাচ্ছিলেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে হলো, এবার তিনি রামকে সিংহাসনে বসিয়ে অবসর জীবন যাপন করবেন। এই সিদ্ধান্তে প্রজারা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। রাজপরিবারেও আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।
কিন্তু একমাত্র একজনের মনে শান্তি নেই—সে হল কৈকেয়ীর দাসী মন্থরা। সে চুপচাপ বসে চিন্তা করতে লাগল। রাম রাজা হলে সবাই কৌশল্যাকে বেশি আদর করবে, আর কৈকেয়ী ও ভরত অবহেলিত হবে— এমন এক কু-বুদ্ধি তার মনে এলো। তাই সে ছলচাতুরী করে কৈকেয়ীকে বোঝাতে লাগল, “রাম সিংহাসনে বসলে তোমার ও ভরতের গুরুত্ব কমে যাবে। এখনই ব্যবস্থা নাও, নাহলে পরে কিছুই করার থাকবে না!”
কৈকেয়ী উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “তাহলে উপায়?”
মন্থরা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলল, “রাজা তোমাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসেন। তাঁর কাছে দুইটি বর চেয়ে নাও— এক, ভরতকে অযোধ্যার রাজসিংহাসনে বসাতে হবে, আর দুই, রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে পাঠাতে হবে। তাহলেই সমস্যার সমাধান হবে!”
ছোটদের রামায়ণ রাজা দশরথের প্রতিশ্রুতি ও রামের বনবাস
রামের অভিষেকের দিন সকালে মন্থরার কুপরামর্শে কৈকেয়ী রাজসজ্জা ত্যাগ করে ছেঁড়া-ময়লা বস্ত্র পরলেন এবং রাজমহলের মেঝেতে শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। রাজা দশরথ মেজোরানিকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। ব্যাকুল হয়ে তিনি কৈকেয়ীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, রানী তোমার এরকম অবস্থা কেন ? “কী হয়েছে তোমার বলো? তুমি কি চাও বল, তুমি যা চাইবে আমি তাই দেবো!”
বলতেই কৈকেয়ী চোখ মুছে বললেন, “আগে প্রতিশ্রুতি দাও, তুমি আমার চাওয়া পূরণ করবে!”
রাজা কথা দিলেন। তখনই কৈকেয়ী তার সত্যিকারের উদ্দেশ্য প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, “আমার দুটি বর চাই— প্রথমত, রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে পাঠাতে হবে, আর দ্বিতীয়ত, ভরতকে অযোধ্যার রাজসিংহাসনে বসাতে হবে।”
রাজা দশরথ কৈকেয়ী এর কথা শুনে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি কিছুতেই প্রিয়পুত্র রামকে বনবাসে পাঠাতে চান না। কিন্তু তিনি রাজকথা দিয়েছেন, আর রাজা কখনও নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়ে কৈকেয়ীর চাওয়া পূরণ করলেন।
অযোধ্যাজুড়ে নেমে এলো বিষাদের ছায়া। প্রজারা কান্নায় ভেঙে পড়ল, রাজপরিবার শোকে মুহ্যমান হয়ে গেল। কিন্তু এ শোকে রামের মন ভেঙে পড়ল না। তিনি ধৈর্য ও শান্ত স্বভাবে পিতার আদেশ মাথা পেতে নিলেন এবং বনবাসের জন্য প্রস্তুতি নিলেন।
রামের সঙ্গে যেতে দৃঢ় সংকল্প করলেন সীতা। স্বামীর পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করে তিনি বললেন, “আপনি যেখানে যাবেন, আমিও সেখানে যাবো!” লক্ষ্মণও নির্দ্বিধায় বললেন, “ভাই, আমি আপনাকে একা যেতে দেবো না!”
তিনজন রাজপোশাক ত্যাগ করে গাছের বাকল পরিধান করলেন এবং একসঙ্গে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করলেন। রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ গভীর বনের পথে এগিয়ে গেলেন— পিতার সত্য রক্ষার জন্য, ধর্মের পথ অনুসরণ করার জন্য, এবং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করার জন্য।
তৃতীয় অধ্যায় ছোটদের রামায়ণ অরণ্য কাণ্ড

ছোটদের রামায়ণে চিত্রকূট থেকে পঞ্চবটী
এই দিকে ভরত মামা বাড়ি থেকে ফিতে সব জানতে পারে, আর তক্ষুনি ভ্রাতা রাম কে ফিরিয়ে আনার জন্য বনে গেলেন, কিন্তু শ্রারীম, ভরতকে ফিরিয়ে দিলেন আর ওই চিত্রকূট পর্বতের বনে থাকতে চাইলেন না। তিনি সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে অন্য নতুন কোনো বনের সন্ধানে চললেন। যেতে যেতে তাঁরা হাজির হলেন অত্রিমুনির আশ্রমে। কয়েক দিন সেখানে থেকে তাঁরা যাত্রা করলেন দণ্ডকারণ্যের পথে। স্থির করলেন সেখানে গিয়ে বাস করবেন। এভাবে নানা বনে বাস করতে করতে দশ বছর কেটে গেল। একদিন তাঁরা হাজির হলেন অগস্ত্যমুনির তপোবনে।
সেখানে কিছুকাল কাটানোর পর অগস্ত্যমুনির পরামর্শে গোদাবরী নদীর তীরে পঞ্চবটী বনে গিয়ে কুটির তৈরি করে রাম-সীতা-লক্ষ্মণ বাস করতে থাকলেন। সুন্দর বন এই পঞ্চবটী। ফল-ফুলের কোনো অভাব নেই। বনের জীবজন্তুরা মনের সুখে বিচরণ করে। মুনি-ঋষিরা সন্তানের মতো তাঁদের দেখাশোনা করেন।
রাম ভাবলেন, আর কোথাও যাবেন না। চোদ্দো বছরের আর চার বছর মাত্র বাকি আছে। এই চার বছর তাঁরা এখানে কাটিয়ে দেবেন।কিন্তু তা হল কই,
শূর্পণখার অপমান ও রাবণের প্রতিশোধ
একদিন রাবণের বোন রাক্ষসী শূর্পণখা আর তার দুই রাক্ষস ভাই খর ও দূষণ হাজির হল বনে । রাক্ষসেরা দরকার মতো নানা রূপ ধারণ করতে পারে। শূর্পণখা একদিন সুন্দরী নারীর রূপ ধারণ করে রামের কাছে এসে বলল, ‘তুমি আমায় বিয়ে করো।’ রাম তাকে তাড়িয়ে দিতে শূর্পণখা এবার গেল লক্ষ্মণের কাছে। লক্ষ্মণ খুবই বিরক্ত হলেন । আর তির ছুড়ে তখনই তার নাক ও কান দুটো দিলেন কেটে ।
বোনের এই অপমান দেখে খর ও দূষণ খুবই রেগে গেল। তারা আক্রমণ করল রাম ও লক্ষ্মণকে। রাম ধনুকে তির যোজনা করে খর ও দূষণ দুই রাক্ষসকে মেরে ফেললেন সহজে।
শূর্পণখা তখন কাঁদতে কাঁদতে বড়োভাই রাবণের কাছে নালিশ করল। নালিশ শুনে রাক্ষসরাজ রাবণ গেলেন খুবই রেগে। বোনের নাক-কান কাটা ও দুই ভাইয়ের মৃত্যুতে খুবই অপমানিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ঠিক করলেন—সীতাকে হরণ করে রাম-লক্ষ্মণকে জব্দ করতে হবে। তিনি তখনই মারীচ রাক্ষসকে সোনার হরিণ সেজে রামের কুটিরের কাছে ঘোরাফেরা করতে নির্দেশ দিলেন।
ছোটদের রামায়ণ সোনার হরিণ ও সীতাহরণ
রাবণের হুকুমে পঞ্চবটী বনে রামের কুটিরের সামনে মারীচ চরে বেড়াতে লাগল । সীতা আশ্রমের বাগানে ফুল তুলছিলেন। তিনি সোনার হরিণ দেখে অবাক হলেন । রামকে বললেন, ‘ওই সোনার হরিণটি আমার চাই।’ লক্ষ্মণকে সীতার পাহারায় রেখে রাম সোনার হরিণ ধরতে গেলেন। তিরধনুক হাতে ছুটলেন সোনার হরিণের পিছু পিছু। মায়াবী মারীচ রামকে ভুলিয়ে অনেক দূরে নিয়ে গেল। রাম যখন তাকে মারবার জন্য তির নিক্ষেপ করছেন, ঠিক সেই সময় মারীচ রামের গলার স্বর নকল করে চিৎকার করে বলল, ‘ভাই লক্ষ্মণ আমাকে বাঁচাও। রাক্ষসেরা আমাকে মেরে ফেলছে।’
রামের করুণ আর্তনাদ শুনে সীতা খুবই ব্যাকুল হলেন। লক্ষ্মণকে ডেকে বললেন, “তোমার দাদার নিশ্চয় কোনো বিপদ হয়েছে। তুমি এখনই তিরধনুক নিয়ে উদ্ধারে চলে যাও।’
লক্ষ্মণ সীতাকে বললেন, ‘রামের কোনো বিপদ হতে পারে না। তা ছাড়া আমি আপনার পাহারায় আছি। একা ফেলে চলে যাওয়া সম্ভব নয়।’ শেষ পর্যন্ত সীতার জেদাজেদিতে লক্ষ্মণকে চলে যেতে হল। যাওয়ার আগে কুটিরের চারদিকে গণ্ডি এঁকে দিলেন। বললেন, ‘এই গণ্ডির বাইরে পা দেবে না।’ লক্ষ্মণ চলে যেতেই রাবণ সন্ন্যাসীর বেশে সীতার কুটিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভিক্ষা চাইলেন। গণ্ডির বাইরে এসে ভিক্ষা দিতে বললেন। যেই গণ্ডির বাইরে পা রেখেছেন, অমনি সন্ন্যাসীবেশী রাবণ সীতাকে জোর করে ধরে রথে তুলে আকাশ পথে উড়ে চললেন। সীতার কান্নাকাটি কাকুতিমিনতিতে রাবণ কর্ণপাত করলেন না ।
সীতার কান্না শুনে পক্ষীরাজ জটায়ু রাবণকে বাধা দিল। ভীষণ যুদ্ধে জটায়ু ঠোঁট দিয়ে নখ দিয়ে রাবণের দেহ রক্তাক্ত করল। কিন্তু তাতে রাবণকে পরাস্ত করা গেল না। রাক্ষসরাজ রাবণ তাঁর তলোয়ারের আঘাতে পক্ষীরাজের ডানা দুটি কেটে দিল। গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল জটায়ু।
সীতা উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের গায়ের অলংকারগুলি একে একে খুলে নীচে ছুড়ে দিতে থাকলেন। যদি কেউ তাঁর নিক্ষিপ্ত গয়না দেখে তাঁর অপহরণ পথের দিশা খুঁজে পেতে পারেন। ঋষ্যমূক পর্বতে থাকা বানরবীর সুগ্রীব ও হনুমান ইত্যাদিরা কয়েকখানা অলংকার পেয়েছিলেন।
লঙ্কায় পৌঁছে রাবণ সীতাকে নিয়ে অশোকবনে বন্দি করে রাখলেন। পাহারায় থাকল ভীষণ চেহারার কয়েকজন রাক্ষসী চেড়ি।
সীতা হরণে রামের বিলাপ
এদিকে মারীচকে বধ করে রাম ও লক্ষ্মণ কুটিরে ফিরে এসে দেখলেন সীতা নেই। সীতার খোঁজে বেরিয়ে আহতও মৃতপ্রায় জটায়ুর সঙ্গে সাক্ষাত হল । তাঁর কাছ থেকে রাবণের সীতা হরণের কথা জানতে পারলেন। দুঃখে রামের চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরতে লাগল। হা-হুতাশ করতে লাগলেন। রাজনন্দিনী হয়ে যে বনবাসে তাঁর সঙ্গে কষ্টের জীবন বেছে নিয়ে অশেষ ক্লেশের জীবনযাপন করছিলেন, সে আজ কোথায় ? দাদাকে জড়িয়ে ধরে লক্ষ্মণও হুহু করে কাঁদতে শুরু করে দিল।