
মহা শিবরাত্রি ব্রতকথা—পুরাকালের কথা:একদিন কৈলাস পর্বতে হর-পার্বতী বসে বিশ্রাম করছিলেন, এমন সময় দেবী বললেন, “প্রভু! ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ লাভের জন্য কী কাজ বা ব্রত পালন করলে আপনাকে সন্তুষ্ট করা যায়?”
ফাল্গুন মাসের মহা শিবরাত্রি ব্রতকথা মাহাত্ম্য
মহাদেব বললেন, “শোনো পার্বতী, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথির অন্ধকার রাত্তিরকে ‘শিবরাত্রি’ বলে। সেদিন যে উপোস করে থাকে, আমি যথার্থই তার ওপর প্রসন্ন হই। এই ব্রত আমার খুবই প্রীতিকর, এই ব্রতের গুণেই গণেশ সপ্ত দ্বীপের অধীশ্বর হয়েছে। এখন এই তিথির মাহাত্ম্য বলছি শোনো।
এক ব্যাধের শিবরাত্রি ব্রত পালনের ঘটনা
পুণ্যতীর্থ কাশী নগরে এক ব্যাধ বাস করত। প্রাণী বধ করাই ছিল তার কাজ। একদিন সে তীর ধনুক নিয়ে শিকার করতে বেরুলো। একটা বনে গিয়ে সে অনেক রকমের পশু-পক্ষী শিকার করল। সে যখন শিকার জড়ো করে বাড়ি ফিরবে তখন দেখল যে, তার শিকারের মাংস খুব ভারী হয়ে উঠেছে, একলা সেগুলো নিয়ে যাওয়া খুবই কষ্টকর। তখন সে সেই বনের একটা গাছের তলায় সেগুলো রেখে একটু বিশ্রাম করতে লাগল। খুব ক্লান্ত হয়ে থাকার দরুণ কিছুক্ষণের মধ্যেই সে গভীর ভাবে ঘুমিয়ে পড়ল।
সূর্য ডুবে যাবার অনেকক্ষণ পর তার ঘুম ভাঙ্গলো, তখন সে দেখল যে—চারিদিক ভয়ানক অন্ধকার হয়ে গেছে, এখন সেখানে বসে থাকলে সাপ কিংবা বাঘ-ভাল্লুকের হাতে তার প্রাণ যেতে পারে। এই অন্ধকারে পথ চিনে কুটীরে ফেরাও এখন সম্ভব নয়। তখন সে হাতড়ে হাতড়ে সেই গাছটার উপরেই মাংসের বোঝাটা নিয়ে উঠে পড়ল এবং মাংসের বোঝাটা গাছের লতাপাতা দিয়ে একটা ডালে বেঁধে রেখে কোনো রকমে গাছে বসেই রাত কাটাবে ঠিক করল।
অজান্তেই শিবের পূজা
একে সে ক্ষিধের জ্বালায় অস্থির, তার ওপর শিশির পড়তে থাকায় শীতে তার কাঁপুনি ধরল, কাজেই সে জেগে বসে রইল সারা রাত। সেটা ছিল বেলগাছ আর ঘটনাচক্রে আমার একটা লিঙ্গমূর্তিও ছিল সেই গাছের তলায়। সেদিন ছিল শিবরাত্রি তিথি এবং ব্যাধও সারাদিন উপোসী ছিল। তার নড়াচড়াতে গাছের কয়েকটা পাতা শিশিরে ভিজে তার গা বেয়ে এসে পড়ল সেই শিবলিঙ্গের মাথায়। যদিও শিবরাত্রি ব্রতের নিয়ম পালন করবার জন্যে তার পক্ষে স্নান করা আর পুজো-নৈবেদ্য দেওয়া মোটেই সম্ভব ছিল না, কিন্তু আমি পেলুম কেবল বেলপাতা। তবুও তিথি মাহাত্ম্যের গুণে সে পেল মহাফল, অথচ সে এ ব্যাপারের কিছুই জানল না। সকাল হতেই সে ফিরে গেল তার কুটীরে।
ব্যাধের মুক্তি লাভ
বেশ কিছুকাল পরে তার মৃত্যু হল, তখন যমদূত আর আমার দূতেরাও তার কাছে গিয়ে হাজির হল। তাকে আমার কাছে আনা হবে না বেঁধে যমরাজের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে এই নিয়ে যমদূতদের সঙ্গে আমার দূতদের খুব ঝগড়া বাধলো। শেষে শিবদূতেরা যমদূতদের পরাস্ত করে ব্যাধকে আমার কাছে নিয়ে এল। যম এই ব্যাপার সব জানতে পেরে আমার কাছে আসছিল, পথে নন্দীকে দেখে ব্যাধের সারাজীবন ধরে কুকর্মের কথা বলল। নন্দীও যমকে ব্যাধের শিবরাত্রির ঘটনার কথা সমস্ত বলে আরও বলল যে, সে শুধু কুকর্মই করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই—সে মহাপাপীও ছিল, কিন্তু শিবরাত্রি ব্রতের ফলে সে শিবলোক লাভ করেছে। যম সব শুনে সন্তুষ্ট হয়ে নিজের পুরীতে ফিরে গেল। দেখলে পার্বতী, এই ব্রতের শক্তি কতখানি?” সেই থেকে পৃথিবীতে এই ব্রতের মাহাত্ম্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
শিবরাত্রি ব্রতের উপকারিতা
১. সকল পাপ থেকে মুক্তি—শিবরাত্রি ব্রত পালনের ফলে মানুষের অতীতের পাপ ক্ষয় হয় এবং জীবনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়। এটি আত্মশুদ্ধির একটি মহামূল্যবান উপায়।
২. ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ লাভ—শিবরাত্রি ব্রত পালন করলে মানুষের ধর্মচেতনা বৃদ্ধি পায়, জীবনে অর্থের অভাব দূর হয়, কাম বা জীবনের ইচ্ছাগুলি পূরণ হয় এবং পরম মোক্ষলাভ সম্ভব হয়।
৩. সংসার জীবনের সকল বাধা ও দুঃখ দূর হয়—যারা নিষ্ঠাভরে শিবরাত্রি ব্রত পালন করে, তাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনের সকল সংকট কেটে যায় এবং জীবনে শান্তি আসে।
৪. অজান্তেও শিবের আরাধনার ফলে মোক্ষ লাভ—যারা অজান্তেই এই ব্রত পালন করে, তারাও মহাদেবের কৃপায় শিবলোক লাভ করতে পারে। শিবের দয়ায় জীবনের সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যায়।
৫. দীর্ঘায়ু ও শিবের কৃপা লাভ—এই ব্রত পালনের ফলে মানুষের আয়ু বৃদ্ধি পায় এবং মহাদেবের আশীর্বাদ লাভ হয়। যারা নিয়মিতভাবে এই ব্রত পালন করে, তারা সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবন উপভোগ করতে পারে।
শিবরাত্রি ব্রত পালনের মাধ্যমে মানুষ নিজের আত্মার শুদ্ধি সাধন করতে পারে এবং জীবনের সকল বাধাবিপত্তি দূর করতে সক্ষম হয়। এটি শুধুমাত্র শিবভক্তদের জন্য নয়, বরং প্রতিটি মানুষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ও পূণ্যের সোপান হিসাবে বিবেচিত হয়।