
শঙ্খচূড়ের বিনাশের জন্য মহাদেবের দায়িত্ব গ্রহণ
তুলসী দেবীর কাহিনী:- ব্রহ্মা, মহাদেবকে দানব শঙ্খচূড়ের বিনাশের দায়িত্ব অর্পণ করে নিজ ধামে প্রস্থান করলেন। মহাদেবও দেবতাদের কষ্ট দূর করতে চন্দ্রভাগা নদীর তীরে এক মনোরম বটগাছের ছায়ায় অবস্থান করতে লাগলেন এবং তিনি গন্ধর্বরাজ পুষ্পদন্তকে দূতরূপে শঙ্খচূড়ের কাছে পাঠালেন।
পুষ্পদন্ত দানবরাজ শঙ্খচূড়ের রাজসভায় উপস্থিত হয়ে রাজাকে বললেন— “হে মহারাজ, আমি শিবদূত, আমার নাম পুষ্পদন্ত। মহাদেব আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন, তাঁর আদেশ আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়া জন্য। শুনুন, সমস্ত দেবগণ সেই সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রীহরির শরণাপন্ন হয়েছেন। অতএব, আপনি এখনই দেবতাদের রাজ্য ও অধিকার ফিরিয়ে দিন। শ্রীহরি ত্রিলোচন শিবকে নিজ শূল অর্পণ করেছেন এবং তিনি এখন চন্দ্রভাগা নদীর তীরে বটমূলে অবস্থান করছেন। আপনি দেবগণকে তাদের রাজ্য ফিরিয়ে দিন অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন। বলুন, আমি মহাদেবের কাছে গিয়ে কী বার্তা পৌঁছাব?”
শিব দূত পুষ্পদন্ত ফিরে যাওয়া ও দেবী তুলসী যুদ্ধের সংবাদ শোনা
শঙ্খচূড় শিবদূতের কথা শুনে উচ্চহাস্যে বলেন— “তুমি এখন ফিরে যাও। আমি আগামীকাল সকালে সেখানে উপস্থিত হব।” পুষ্পদন্ত ফিরে এসে শঙ্খচূড়ের বিষয়ে মহাদেবকে সব কথা জানালেন। তখন শিবের সেনাপতি কার্তিক, বীরভদ্র, নন্দী, মহাকাল, একাদশ রুদ্র, অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য, অগ্নি, চন্দ্র, বিশ্বকর্মা, কুবের, যম, জয়ন্ত, বায়ু, বরুণ, বুধ, মঙ্গল, কামদেব, উগ্রচণ্ডা, কোটরী, ভদ্রকালীসহ শিবের পক্ষের সকল দেব-দেবী নানা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন।
এদিকে, শঙ্খচূড় নিজ পুরীতে ফিরে গিয়ে স্ত্রী তুলসীকে আসন্ন যুদ্ধের কথা জানালেন। যুদ্ধের কথা শুনেই তুলসীর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল, গলা শুকিয়ে এল, ওষ্ঠ শুষ্ক হয়ে উঠল। তিনি ব্যাকুল হৃদয়ে স্বামীর দিকে চেয়ে বললেন, “হে প্রাণনাথ! আপনি তো আমার প্রাণের প্রাণ! অন্তত ক্ষণিকের জন্য হলেও আমার জীবন রক্ষা করুন, আমার হৃদয়ের অভিলাষ পূর্ণ করুন।”
পলকহীন দৃষ্টিতে তুলসী তাঁর স্বামীর মুখপানে চেয়ে রইলেন, তারপর কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “নাথ, আমার হৃদয় আন্দোলিত হচ্ছে, মন দগ্ধ হচ্ছে। আজ রাত্রে এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছি…”
শঙ্খচূড়ের তুলসী দেবীকে হিতকর উপদেশ প্রদান
প্রাজ্ঞ দানবরাজ, তুলসীর সেই কথা শুনে পান-ভোজন শেষ করে সত্য ও হিতকর উচিত কথা বলতে লাগলেন— “জীবগণের কর্মভোগের সময় উপস্থিত হলেই শুভ-অশুভ, সুখ-দুঃখ, ভয়-শোক, অমঙ্গল—সমস্তই সংঘটিত হয়। দেখ, বৃক্ষ যে-কোনো সময়ে জন্ম নেয়, তারপর যথা সময়ে তার ডাল-পালা গজায়, ফুল ও ফল ধারণ করে এবং নির্ধারিত সময় সেই ফলবান বৃক্ষ কালের প্রভাবে ধ্বংস হয়। এভাবেই সমস্ত প্রাণী কালের বক্ষে জন্মলাভ করে এবং পুনরায় কালের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। শুধু কি জীবগণ? পরন্তু সমগ্র বিশ্বও কালের গতি অনুসারে সৃজিত হয় এবং শেষে কালের গর্ভে বিলীন হয়।
স্রষ্টা কালের মধ্যে সৃষ্টি করেন, পালনকর্তা কালের মধ্যেই পালন করেন এবং সংহারকর্তা সেই কালের মধ্যেই সমস্তকিছু সংহারে ব্রতী হন। এই নিয়মেই সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের চক্র আবর্তিত হয়। অতএব, যিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরাদিরও অধিষ্ঠাতা, যিনি স্রষ্টা, পালনকর্তা ও সংহারকর্তা—সেই অনন্ত, অনাদি, পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকেই নিরন্তর ভজনা কর।
শ্রীকৃষ্ণই স্বীয় ইচ্ছায় প্রকৃতিকে সৃষ্টি করে সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় জড় ও জীব পদার্থকে বিকশিত করেছেন। ব্রহ্মা থেকে শুরু করে পৃথিবীর সমস্ত বস্তুই কৃত্রিম ও নশ্বর। সবই কালের অধীন, কালে জন্মগ্রহণ করে এবং কালের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। অতএব, তুমি সেই ত্রিগুণাতীত, চিরসত্য, পরম ব্রহ্ম, রাধাকান্ত ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ কর এবং তাঁকেই একমাত্র আরাধনা কর।”
তিনি সর্বেশ্বর, সর্বান্তরাত্মা ও সর্বস্বরূপ—যিনি জলরূপে জলের সৃষ্টি, পালন ও সংহার করেন, সেই শ্রীকৃষ্ণকেই ভজনা কর । যাঁর আদেশে বায়ুদেব অনবরত দ্রুতগতি নিয়ে বিচরণ করেন, সূর্যদেব যাঁর নির্দেশে যথাসময়ে তাপপ্রদান করেন, ইন্দ্র যাঁর আদেশে শুভ সময়ে বারি বর্ষণ করেন, যম যাঁর শাসনে সমস্ত প্রাণির মধ্যে বিচরণ করেন, অগ্নিদেব যাঁর শক্তিতে দহন করেন, এবং চন্দ্র যাঁর ভয়ে নিরবচ্ছিন্ন ভ্রমণ করেন—সেই অনন্ত পরমেশ্বরের শরণাপন্ন হও।
তিনি মৃত্যুরও মৃত্যু, কালেরও কাল, যমেরও যম, সৃষ্টিরও স্রষ্টা, পাতারও পাতা এবং সংহারকারীর সংহারকারী। তিনিই প্রকৃত আশ্রয়স্থল।
এই জগতে কেউ কারও প্রকৃত বন্ধু নয়—শুধু তিনিই সর্বজীবের একমাত্র পরম বন্ধু। অতএব, তাঁরই চরণে সমর্পিত হও, তাঁরই সেবা কর।
তুলসী ও শঙ্খচূড়: এক বিভোর ভালোবাসার অন্তিম পরিণতি
প্রিয়তমে, আমিই বা কে? আর তুমিই বা কে? কেবল নিজ কর্মবশত বিধাতা আমাদের মিলিত করেছেন, আবার তিনিই আমাদের বিচ্ছিন্ন করবেন। অজ্ঞানীরাই শোক বা বিপদে ভয় পায়, কিন্তু পণ্ডিতেরা কখনো বিচলিত হন না। কারণ, সুখ আর দুঃখ চক্রের মতো নিরন্তর আবর্তিত হচ্ছে।
প্রিয়ে, বদরিকাশ্রমে তুমি যাঁর জন্য তপস্যা করেছিলে, নিশ্চয়ই সেই সর্বেশ্বর নারায়ণকে স্বামীরূপে লাভ করবে। হে কামিনি, আমি কঠোর তপস্যার ফলে ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত হয়ে তোমাকে পেয়েছি। কিন্তু তুমি যে তপস্যা করেছিলে, তা ছিল হরির উদ্দেশ্যে, তাই শেষ পর্যন্ত হরিকেই লাভ করবে। তুমি অতি শীঘ্রই গোলোকধামের বৃন্দাবনে গোবিন্দকে পাবে, আর আমিও এই দানবদেহ ত্যাগ করে সেই স্বর্গীয় স্থানে গমন করব।
সেখানে তুমি আমাকে, আমি তোমাকে নিরন্তর দেখতে পাব। রাধিকার শাপে আমি এই সুদুর্লভ ভারতে জন্মগ্রহণ করেছি, কিন্তু আবার সেখানেই ফিরে যাব। অতএব, প্রিয়ে, আমার জন্য শোক করার প্রয়োজন নেই। তুমিও এই দেহ ত্যাগ করে দিব্যরূপে শ্রীহরিকে লাভ করবে, তাই বৃথা কাতর হয়ো না।
এত কিছু বলার পরও তুলসী স্বামীর বিচ্ছেদে ব্যথিত হয়ে কাঁদতে থাকলে, দৈত্যরাজ তাঁকে পুনরায় প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দিয়ে সান্ত্বনা দিলেন। এই জ্ঞান, যা একসময় শ্রীকৃষ্ণ ভাণ্ডীর বনে প্রদান করেছিলেন, পরে শঙ্খচূড় সেই উৎকৃষ্ট, সর্বশোক বিনাশকারী জ্ঞান তুলসীকে দান করেন। জ্ঞানলাভের ফলে তুলসীর মুখমণ্ডল ও নয়ন যুগল প্রসন্ন হয়ে উঠল, এবং তিনি সকল কিছু নশ্বর বিবেচনা করে আনন্দে স্বাভাবিক হয়ে গেলেন।
শঙ্খচূড়ের রণসজ্জা ও দেবতাদের প্রস্থান
পরদিন সকালে দানবরাজ স্নান সেরে শুদ্ধবস্ত্র পরিধান করলেন। তিনি নিজেকে উত্তম সাজে সুসজ্জিত করে, পূজার্চনার জন্য আরাধ্য দেবতার উপাসনায় নিমগ্ন হলেন। পূজা শেষে ব্রাহ্মণকে সোনা, মণি, মাণিক্য, রত্ন ও ধেনু দান করলেন এবং নিজের পুত্র সুচন্দ্রকে দানবরাজ্যের সিংহাসনে অভিষিক্ত করলেন। এরপর তিনি যুদ্ধসাজে সজ্জিত হলেন, অস্ত্র-শস্ত্রধারী এক বিশাল বাহিনী সংগঠিত করলেন এবং শ্রীহরির স্মরণ করে যুদ্ধে যাত্রা করলেন।
যুদ্ধস্থলে পৌঁছে, অক্ষয়বটের নীচে বিরাজিত বিশ্বনাথ ও সমগ্র দেবতাদের শ্রীচরণ বন্দনা করলেন। দানবরাজের গভীর ভক্তি ও বন্দনায় মুগ্ধ হয়ে চন্দ্রশেখর তাঁকে আশীর্বাদ করলেন এবং তাঁর পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন। তিনি দানবরাজের জন্মের কারণ এবং তাঁর বর্তমান জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন। দেবগণের স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তিনি দানবরাজকে স্বর্গরাজ্য পরিত্যাগ করার পরামর্শ দিলেন এবং পরমেশ্বরের অনন্ত মহিমা ব্যক্ত করলেন।
কিন্তু দানবরাজ চন্দ্রশেখরের কথায় দেবগণকে স্বর্গরাজ্য ফিরিয়ে দিতে রাজি হলেন না। বরং তিনি দেবগণের দ্বারা দানবদের প্রতি সংঘটিত বিভিন্ন অবিচারের দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেন। এই বিতর্কের পর দেবতা ও দানবদের মধ্যে এক ভয়ংকর মহাযুদ্ধের সূচনা হলো।
উক্ত যুদ্ধে বহু দানব ও দেবতা হতাহত হলেন, কিন্তু কেউই শঙ্খচূড়কে পরাজিত করতে পারলেন না। তার অজেয়তার মূল কারণ ছিল তাঁর হাতে ধারণ করা এক দিব্য কবচ। ভগবান নারায়ণ এক ব্রাহ্মণের রূপ ধারণ করে কৌশলে শঙ্খচূড়ের নিকট থেকে সেই দিব্য কবচ ভিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করলেন। পাশাপাশি, নারায়ণের ছলনার ফলে দেবী তুলসীর প্রতিব্রত্যা ব্রতও ভঙ্গ হল।

মহাদেবের ত্রিশূল নিক্ষেপ ও শঙ্খচূড়ের মুক্তি
যখন শঙ্খচূড় কবচহীন হলেন, তখন মহাদেব শিব স্বয়ং ভগবান নারায়ণের প্রদত্ত ভয়ঙ্কর ত্রিশূল দানবরাজের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। বিশ্ব ধ্বংসকারী সেই মহাশক্তিশালী শূল দানবরাজের দিকে ধেয়ে আসতে দেখে, তিনি সমস্ত অস্ত্র ত্যাগ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণ স্মরণ করতে লাগলেন।
সে সময় শূল তাঁর উপর এসে পড়লে, তিনি রথ-সহ ভস্মীভূত হয়ে দ্বিভুজ, মুরলীহস্ত, রত্নভূষণে বিভূষিত, দিব্য কিশোররূপে আবির্ভূত হন। তখন গোলোক থেকে আগত, উৎকৃষ্ট রত্ননির্মিত, কোটি গোপগণে বেষ্টিত এক দেবযানে আরোহণ করে তিনি গোলকপুরে গমন করেন।
সেখানে পৌঁছে, তিনি রাধা-মাধবের শ্রীচরণ বন্দনা করে প্রণাম করেন। সুদামাকে দেখে উভয়ের মুখমণ্ডল ও নয়নযুগল প্রসন্ন হয়ে ওঠে। আনন্দে অভিভূত হয়ে তাঁরা স্নেহভরে সুদামাকে কোলে তুলে নেন।
এদিকে, সেই শূল শঙ্খচূড়কে বিনাশ করে শিবের হাতে ফিরে আসে। শঙ্কর সেই শূল পেয়ে “শূলপাণি” নামে খ্যাত হন। পরে, স্নেহবশত তিনি সেই শূল দিয়ে শঙ্খচূড়ের অস্থিগুলি লবণসমুদ্রে নিক্ষেপ করেন।
শঙ্খের উৎপত্তি ও দেবপূজায় শঙ্খের গুরুত্ব
শঙ্খচূড়ের দেহ থেকে শঙ্খের উৎপত্তি: শঙ্খচূড়ের সেই অস্থি থেকে দেবপূজায় ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন শঙ্খজাতির উৎপত্তি হল। সেই শঙ্খের জল তীর্থবারিস্বরূপ, অত্যন্ত পবিত্র এবং দেবগণের প্রীতিজনক। শঙ্খে সর্বদা শ্রীহরির অধিষ্ঠান থাকে, আর যেখানে শঙ্খ থাকে, সেখানেই ভগবান বিষ্ণু ও লক্ষ্মীদেবীর অবস্থান। শঙ্খের এই মহিমা অসীম ও অনন্ত।
যুদ্ধে শঙ্খচূড় শিবের হাতে নিহত হয়ে গোলোকে গমন করেন। অন্যদিকে, তুলসী যখন শ্রীহরির ছলনা বুঝতে পারেন, তখন ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হন। ভগবান শ্রীহরি অভিশাপের ভয়ে সুমনোহর রূপ ত্যাগ করে তাঁর নিজস্ব রূপ ধারণ করেন। তখন তুলসী তাঁর সম্মুখে নবীন-নীরদশ্যাম, অপরূপ শ্রীভগবানকে দর্শন করেন এবং মুহূর্তেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি বিষাদভরে বলতে লাগলেন, “নাথ, আপনার কোনো দয়া নেই! আপনার ছলনার কারণে আমার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। তাই আপনি পাথরের মতো নিষ্ঠুর! যে আপনাকে দয়ার সিন্ধু বলে, সে নিশ্চয়ই ভুল বলে। আপনি সর্বজ্ঞ ও সর্বাত্মা হয়েও অন্যের দুঃখ অনুভব করেন না—এ কারণে এক জন্মে আপনাকে আত্ম-বিস্মৃত হতে হবে।” এই কথা বলে তুলসী শ্রীহরির চরণে লুটিয়ে পড়েন এবং ক্রন্দন করতে থাকেন।
তুলসীর অভিশাপ ও শ্রীহরির বরদান
তখন করুণাসাগর কমলাপতি, তুলসীর সকরুণ বিলাপ শুনে সান্ত্বনা দিতে নীতি-কথা বলতে লাগলেন—
**“হে সাধ্বি, তুমি আমার জন্য বহুদিন ভারতে তপস্যা করেছিলে। তেমনি কামী শঙ্খচূড়ও তোমার জন্য তপস্যা করেছিল, যার ফলে সে তোমাকে স্ত্রীরূপে লাভ করে। এখন আমারও উচিত তোমাকে তপস্যার ফল দান করা। তুমি এই নশ্বর শরীর ত্যাগ করে দিব্যদেহ ধারণ করো এবং রমার মতো রাসমণ্ডলে আমার সঙ্গে অবস্থান করো। তোমার এই শরীর ভারতে ‘গণ্ডকী’ নামে এক প্রসিদ্ধা নদীতে পরিণত হোক, যা মানুষের পুণ্যদান করবে।
আর তোমার কেশকলাপ থেকে জন্ম নিক এক পবিত্র বৃক্ষ, যা ‘তুলসী’ নামে খ্যাত হবে। এই তুলসী যাবতীয় পত্র ও পুষ্প থেকে শ্রেষ্ঠ হয়ে দেবপূজার জন্য সর্বাধিক প্রশস্ত হবে। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল, বৈকুণ্ঠ ও আমার নিকট তুলসীবৃক্ষ সকল ফুলের চেয়ে শ্রেষ্ঠস্থান লাভ করবে।”**
ওই পুণ্যপ্রদ তুলসী বৃক্ষ জন্ম নেবে গোলোকের বিরজাতীরে, রাসমণ্ডলে, বৃন্দাবন ভূমিতে, ভাণ্ডীর বনে, রমণীয় চম্পকবনে, চন্দনকাননে, মাধবী, কেতকী, কুন্দ, মল্লিকা ও মালতীবনে এবং অন্যান্য যাবতীয় পুণ্যস্থানে। এই তুলসীবৃক্ষের মূলে সকল তীর্থের অধিষ্ঠান থাকবে, আর দেবগণ সেখানে পড়ে থাকা তুলসী পাতার জন্য অপেক্ষায় থাকবেন।
যে ব্যক্তি তুলসীপত্র জলে অভিষিক্ত হবেন, তিনি সকল তীর্থে স্নানের ও সকল যজ্ঞে দীক্ষার ফল লাভ করবেন। সুধাপূর্ণ হাজার ঘট দানে হরির যে প্রীতি অর্জিত হয়, মাত্র একটি তুলসীপত্র দান করেই সেই প্রীতি লাভ করা সম্ভব। মানুষ অযুত গো-দান করে যে ফল পায়, একমাত্র তুলসীপত্র দান করেই সে সেই ফলের অধিকারী হয়।

তুলসী গাছের পবিত্রতা ও তুলসী পত্রের মাহাত্ম্য
যে ব্যক্তি মৃত্যুকালে তুলসীপত্রের জল গ্রহণ করে পায়, সে সকল পাপ থেকে মুক্ত হয়ে বিষ্ণুলোকে গমন করে। যারা নিত্য তুলসীজল পান করেন, তারা জীবনমুক্ত হন এবং গঙ্গাস্নানের পুণ্য লাভ করেন।
প্রতিদিন তুলসীপত্র দিয়ে যারা ভগবানকে পূজা করেন, তারা লক্ষ অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল অর্জন করেন। যারা হাতে ও শরীরে তুলসী ধারণ করে দেহত্যাগ করেন, তারা বিষ্ণুলোক লাভ করেন। তুলসী কাঠের মালা ধারণকারীরা পদে পদে অশ্বমেধ যজ্ঞের পুণ্য লাভ করেন।
তবে, যে ব্যক্তি হাতে তুলসী নিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না, সে চন্দ্র-সূর্য বিদ্যমান থাকা পর্যন্ত কালসূত্র থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। যারা তুলসী ছুঁয়ে মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করে, তারা চৌদ্দজন ইন্দ্র পর্যন্ত কুম্ভীপাক নরকে বাস করে। সবশেষে, যে ব্যক্তি মৃত্যুর সময় একবিন্দু তুলসীজল লাভ করে, সে রত্নযানে চড়ে বৈকুণ্ঠধামে গমন করে।
তুলসীপত্র তোলার বিধি ও পবিত্রতা—
যারা পূর্ণিমা, অমাবস্যা, দ্বাদশী ও সংক্রান্তির দিনে, শরীরে তেল মেখে স্নান করার সময়ে, দুপুর, রাত্রি ও সন্ধ্যার সময় অথবা অশৌচ ও রাত্রির পোশাকে তুলসীপত্র তুলবে, তারা হরির শিরচ্ছেদ করবে।
তুলসীপত্র তিন রাতের পুরোনো হলেও তা শ্রাদ্ধ, ব্রত, দান, প্রতিষ্ঠা ও দেবপূজার জন্য শুদ্ধ বলে গণ্য হবে। বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা তুলসীপত্র যদি মাটিতে বা জলে পড়েও যায়, তবে জলে ধুয়ে নিলেই তা পুনরায় শুদ্ধ হয়ে যাবে এবং অন্যান্য পূজার কাজে ব্যবহার করা যাবে।
যিনি বৃক্ষের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তিনি নিরন্তর গোলোকধামে নির্জনে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে নিত্যলীলা করবেন। যিনি ভারতে পুণ্যপ্রদা নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তিনিও লবণ সমুদ্রের পত্নী রূপে আমার অংশ থেকে জন্ম নেবেন। মহাসাধ্বী স্বয়ং তুমি, বৈকুণ্ঠধামে আমার সঙ্গে রাসলীলায় লক্ষ্মীর সমান স্থান পাবে। আমি তোমার শাপের ফলে ভারতবর্ষে গণ্ডকী নদীর তীরে শৈলরূপে অবস্থান করব।
শ্রীভগবান শঙ্খের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলেন—
“যে শালগ্রাম থেকে তুলসীপত্র বিচ্ছিন্ন করবে, সে জন্ম জন্মান্তরে স্ত্রী-বিচ্ছেদজনিত যন্ত্রণায় ভুগবে। যে শঙ্খকে তুলসী থেকে বিচ্ছিন্ন করবে, সে সাত জন্ম ধরে শ্রীহীন ও রোগাক্রান্ত থাকবে। তবে যে মহাজ্ঞানী ব্যক্তি শালগ্রাম, তুলসী ও শঙ্খকে একত্রে রক্ষা করবে, সে শ্রীহরির প্রিয় হবে।
একবার যে যাকে উপভোগ করেছে, তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ দুঃখজনক হয়। তুমি এক মন্বন্তরকাল ধরে শঙ্খচূড়ের প্রিয়া ছিলে, সুতরাং তার সঙ্গে বিচ্ছেদ তোমার জন্য স্বাভাবিকভাবেই বেদনার কারণ হয়েছে।”
শ্রীহরি সাদরে তুলসীকে সমস্ত কথা বলে থেমে গেলেন। এরপর তুলসী দেহত্যাগ করে দিব্যরূপ ধারণ করে বৈকুণ্ঠধামে গমন করেন। সেখানে তিনি কমলার মতো শ্রীহরির বক্ষস্থলে স্থান লাভ করেন। সেই সময় লক্ষ্মী, সরস্বতী, গঙ্গা ও তুলসী—এই চারজনই পরমেশ্বর হরির প্রিয়া হয়ে ওঠেন।
এদিকে, তুলসী দেহত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর দেহ থেকে গণ্ডকী নদী উৎপন্ন হয় এবং তার তীরে হরির অংশবিশেষ থেকে এক পবিত্র পর্বত সৃষ্টি হয়, যা মানুষের জন্য অশেষ পুণ্যদায়ক হয়ে ওঠে।
তুলসী দেবীর কাহিনী:- পরবর্তী অংশ
*তুলসী দেবীর জন্ম বৃত্তান্ত: ও পুর্বপুরুষদের কাহিনী বর্ণন।
*দেবী তুলসী বিবাহ কাহিনী: তুলসীর জীবন কাহিনী বৃত্তান্ত।
FAQ:- তুলসী দেবী ও শঙ্খচূড়: সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন:- তুলসী দেবীর স্বামীর নাম কী?
উত্তর:- তুলসী দেবীর স্বামীর নাম ছিল শঙ্খচূড়। তিনি এক পরাক্রান্ত অসুর ও ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন।
প্রশ্ন:- তুলসী দেবী ভগবান বিষ্ণুকে কেন অভিশাপ দিয়েছিলেন?
উত্তর:- তুলসী দেবী যখন জানতে পারেন যে ভগবান বিষ্ণু তাঁর স্বামীর রূপ ধারণ করে তাঁকে প্রতারিত করেছেন, তখন তিনি বিষ্ণুকে অভিশাপ দেন যে তিনি শিলায় (শালগ্রাম শিলা) পরিণত হবেন। পরে ভগবান বিষ্ণু তুলসীকে আশীর্বাদ করেন, যাতে তিনি তুলসী গাছের রূপে পবিত্র ও পূজিত হন।
প্রশ্ন:- তুলসী দেবীর আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য কী?
উত্তর:- তুলসী দেবী ভক্তি, পবিত্রতা ও ঈশ্বর প্রেমের প্রতীক। তুলসী গাছের পূজা করলে দেবতার আশীর্বাদ লাভ হয়, পাপ নাশ হয় এবং পরিবারে শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় থাকে। বিষ্ণু ও কৃষ্ণ পূজায় তুলসী পাতা অপরিহার্য বলে গণ্য হয়।